এই উপমহাদেশের খান তিনেক দেশ ছাড়া দুর্গাপুজো আর কোথাও স্বীকৃত উৎসবই নয়। ছবি: শাটারস্টক।
এত দিন মনের মধ্যে একটা খচখচানি ছিল। মা দুর্গা কি সত্যিসত্যিই সর্বজনীন! বারোয়ারি দুর্গাপুজোকে সর্বজনীন বলা হলেও তা কিন্তু কখনই বিশ্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। এই উপমহাদেশের খান তিনেক দেশ ছাড়া দুর্গাপুজো আর কোথাও স্বীকৃত উৎসবই নয়। বিশ্বের যে সব জায়গায় বাঙালি আছে, সেখানে দুর্গাপুজো হয় বটে, কিন্তু সার্বিক স্তরে উৎসব হিসেবে তার কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। কারণ, রাষ্ট্রপুঞ্জের সংগঠন ইউনেস্কো বাঙালির এই সেরা উৎসবকে আগে কখনও স্বীকৃতি দেয়নি। নিছক এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বাইরে বার করে এনে একটি সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে দুর্গাপুজোকে ইউনেস্কো মেনে নেওয়ায় দেবী দুর্গার আরাধনা এ বার থেকে ব্রাজিলের রিয়ো উৎসবের সঙ্গেই এক বন্ধনীতে চলে এল।
কয়েক বছর আগে একদল সাংবাদিকের সঙ্গে ভারতের প্রতিনিধি হয়ে মিশর গিয়েছিলাম। আমাদের ওই দলে ব্রাজিলের এক পেশাদার ফোটোগ্রাফার ছিলেন। আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট। যেখানে যেখানে আমরা গিয়েছি, আমার সঙ্গেই ছিলেন তিনি। একটা জায়গায় আমাদের নিজের নিজের শহরের সেরা উৎসব নিয়ে বলতে বলা হল। আমি ওই ব্রাজিলীয় ফোটোগ্রাফারকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম, কী নিয়ে বলব। আর তিনিও আমাকে ওঁর বিষয়টি জানিয়ে রেখেছিলেন। আমি যে বিষয়টির কথা বলব বলেছিলাম, তার সম্পর্কে ওঁর কোনও ধারণাই ছিল না। জানতেন তো না-ই, কোনও দিন শোনেননি। আর তিনি তাঁর শহরের উৎসবের যে ছবি আমাকে দেখালেন, সে তো আমি অনেক বার টেলিভিশনেই দেখেছি। রিয়ো ফেস্টিভ্যাল। মূল অনুষ্ঠানেও দেখলাম দুর্গাপুজোর বিষয়টি কেউ শোনেননি। তবে আমার কথা শুনে বিস্তর হাততালি পড়েছিল। আর ওই ব্রাজিলীও ফোটোগ্রাফার যা বললেন, তাতে শ্রোতাদের চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে পরিষ্কার যে, রিয়ো ফেস্টিভ্যাল সম্পর্কে সবাই অবহিত। তবে দুর্গাপুজো সম্পর্কে কিছু জানতেন না। খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। বুঝেছিলাম, আমাদের মা দুর্গা সর্বজনীন হলেও, বিশ্বজনীন নয়!
ওই ব্রাজিলীও ফোটোগ্রাফার আমাকে বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের এই কালারফুল ফেস্টিভ্যাল সম্পর্কে নিশ্চয়ই এক দিন পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষ জানতে পারবেন। শুধু এক বার নাম তুলতে হবে ইউনেস্কোর তালিকায়।’’ আমি ভাবছিলাম, তার জন্য আমাদের দেশের সরকারকে তো সব থেকে বেশি করে উদ্যোগী হতে হবে। কিন্তু ভারত সরকার কি করবে? বিভিন্ন দেশে ঘোরার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ভারতীয় দূতাবাসগুলি নিয়ম করে ‘পর্যটন মেলা’ করে, ‘রোড শো’ করে । বিদেশি পর্যটকের পাশাপাশি বিনিয়োগ টানতে নানা ভাবে দেশকে তুলে ধরে। তাতে কখনও দুর্গাপুজো কয়েক সেকেন্ডের জন্য আসে। কখনও বা এক বারের জন্যও আসে না। তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার যতই চেষ্টা করুক না কেন, কেন্দ্রীয় সরকারের টনক নড়ে না। এ বার যা ঘটেছে তা ব্যতিক্রম। জগৎসভায় দুর্গোৎসব তার নিজের জায়গাটা পেয়েছে।
এত দিন যে কেন পেল না, তা নিয়ে চর্চা করে আর লাভ নেই। বরং আসুন দুর্গাপুজোর এই স্বীকৃতি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতটা একটু বুঝে নিই।
এটা এমন একটা উৎসব যা জাতি, ধর্ম, দেশ, কাল, ধনী, দরিদ্র— সব কিছুর ঊর্ধ্বে। ও পার বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এ দেশে উঠে আসা আমার বাবার মুখে তাঁদের গ্রামের দুর্গাপুজোর কথা শুনেছি। সব সম্প্রদায়ের মানুষ কী ভাবে হাতে হাত লাগিয়ে ওই পুজোকে উৎসবের চেহারা দিত তা শুনতে শুনতে দৃশ্যটা কল্পনা করতাম। একটু বড় হয়ে কলকাতার পুজো দেখে বাবার গল্পের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখতাম। বেশ মিলে যেত। যেটা সেই গল্পে ছিল না, তা-ও এক সময় যোগ হল। দুর্গাপুজোর সর্বজনীন হওয়ার গল্প। বিশেষ করে থিম পুজোর উত্থানের পরে পুজোর ব্যাপ্তিটা আরও ছড়িয়ে পড়ল।
সেটা কেমন?
পুজো মানে আর শুধু কুমোরটুলি, পটুয়াপাড়া, চন্দননগর, ডেকরেটরের পুজো থাকল না। গ্রামবাংলার ধুঁকতে থাকা কুটির শিল্পগুলি প্রাণ ফিরে পেল। কুটির শিল্পের লালনভূমি থেকে ভাগ্য অন্বেষণে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া অনেকেই ফিরে এলেন নিজের গ্রামে। সারা বছর নিজের বাড়িতে থেকে তাঁদের অনেকের কাছেই বছরভরের রুজি রোজগারের পথ খুলে দিয়েছে থিম পুজো। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি ওই থিম পুজোর কনেসেপ্টটা এল। ওই সময় কলকাতার পুজোয় আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা একদল শিল্পী এলেন, যাঁরা শুধু মণ্ডপই সাজান না, প্রতিমা গড়েন, আলোর কনসেপ্ট তৈরি করেন, আবহ সঙ্গীত কী হবে সেটাও ঠিক করে দেন (এখনকার ম্যানেজমেন্টের পরিভাষায় মাল্টিটাস্কিং)। তখন আনন্দবাজার পত্রিকা পুজোর সময় খোলা থাকত। আর পুজোর লেখালেখির ভারটা আমার উপর ছেড়ে দিয়ে দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রধান সম্পাদক। পুজোর নতুন এই কনসেপ্টটাকে এক কথায় কী লেখা যায় তা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই কলম দিয়ে ‘থিম’ শব্দটা বেরিয়ে এসেছিল। তখন ‘সস্তায় পুষ্টিকর’ ছিল থিম পুজো। অল্প খরচে ছিমছাম শৈল্পিক মণ্ডপ। তার ভিতরে মানানসই প্রতিমা। বেশ কয়েক জন সহশিল্পীকে নিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়াত নান্দনিক একটা মণ্ডপ।
সেই থিম পুজোর বাজেট ২০ হাজার থেকে বেড়ে এখন দেড় কোটি টাকায় গিয়ে পৌঁছেছে। ১০ জন শিল্পী নিয়ে শুরু করা ওই সব পুজোয় এখন শিল্পী-সহশিল্পীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে হাজারের কাছাকাছি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনুসারী আরও কয়েকশো মানুষ। তা ছাড়া মণ্ডপ ঘিরে যে মেলাটা হয়, সেটার কথা চিন্তা করুন। তাতে বেলুনওয়ালা, ফুচকাওয়ালা, ভেলপুরিয়োয়ালা, নাগরদোলা-পরিচালক— সবাই বাঁচার রসদ খুঁজে পান।
ইউনেস্কোর কাছে ভারত সরকার দুর্গা উৎসব নিয়ে যে ভিডিয়োটি (প্রেজেন্টেশন) জমা দিয়েছিল, তাতে ‘থিম পুজো’র প্রসঙ্গ এসেছে। এসেছে পুজোর সঙ্গে যুক্ত মানুষদের রুজি রোজগারের বিষয়টি। আর তাতে নিজেরই কেমন গর্ব বোধ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল প্রাপ্ত সম্মান এত দিনে পাওয়ায় পুজো পাগলদের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। পুজো পাগল হল শহরের এমন কিছু নাছোড়বান্দা মানুষ, যাঁরা জমি বন্ধক রেখে, স্ত্রী-মেয়ের গয়না বন্ধক রেখে, মহাজনের থেকে চড়া সুদে ধার করে থিম পুজো আর তার সঙ্গে যুক্ত শিল্পী, সহশিল্পী, অনুসারী শ্রমিকদের পেটের ভাত জুগিয়েছেন। করোনা কালের দু’বছর কলকাতার পুজোর উদ্যোক্তা আর শিল্পীদের বড় একটা পরীক্ষা নিয়ে গেল। নিজেরা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে পারিশ্রমিকের পুরোটাই সারা বছর পুজোর মুখ চেয়ে বসে থাকা মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে শিল্পীরা নজির গড়েছেন। আর সেই টাকাটা শিল্পীদের মিটিয়ে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। এই লড়াইয়ের কথাটা নিশ্চয়ই ইউনেস্কোর কানে ওঠেনি। উঠলে আরও সম্মানিত হত কলকাতার পুজো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy