ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের সর্বজনীন দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করিয়া সাম্প্রতিক ঘটনাপরম্পরা দেখিবার পরে মনে হইতেই পারে: দুর্ভাগা সেই দেশ, যেখানে আদালতকে কাণ্ডজ্ঞানের প্রথম পাঠ দিতে হয়। তবে সেখানেই দুর্ভাগ্যের শেষ নহে। আদালতের রায় শুনিয়াও সম্বিৎ ফিরিবার লক্ষণ নাই, নানা ‘যুক্তি’ দেখাইয়া নির্দেশ পুনর্বিবেচনার আবেদনও পেশ হইয়াছে। সেই আবেদনের দ্রুত নিষ্পত্তি করিয়া বিচারপতিরা জনস্বার্থ রক্ষায় যথাসাধ্য উদ্যোগী হইয়াছেন। তাঁহারা কঠোরতর নির্দেশ দিতে পারিতেন কি না তাহা লইয়া কুতর্ক নিষ্প্রয়োজন। যে কোনও কাণ্ডজ্ঞানী মানুষের এখন একটিই চিন্তা: আদালতের অনুশাসন কত দূর বলবৎ হইবে? এই উদ্বেগ দূর করিবার বিশেষ ভরসা শারদীয় পশ্চিমবঙ্গের দৃশ্যাবলিতে নাই— জনসমাগম, কিঞ্চিৎ প্রশমিত হইলেও, চলিতেছে। আশঙ্কা হয়, তাহা ক্রমে বাড়িবে। সেই ভিড়ের সংক্রমণ-ক্ষমতা কত দূর যাইতে পারে, দেবী দুর্গাও তাহা জানেন না। বিপুল উদ্বেগে সওয়ার হইয়াই এই বৎসর তাঁহার আগমন, বিপুলতর উদ্বেগ সঙ্গে লইয়াই তিনি ফিরিবেন।
উদ্বেগ সৃষ্টিতে রাজ্য সরকারের দায় অনস্বীকার্য। অতিমারির বিপদ অজানা ছিল না। জন-উৎসব সেই বিপদকে কতটা বাড়াইয়া দিতে পারে, অন্য রাজ্যের, বিশেষত ওনাম-উত্তর কেরলের অভিজ্ঞতা তাহার বার্তা দিয়াছিল। তাহার পরেও সর্বজনীন পূজাকে ঢালাও ছাড়পত্র দিবার সিদ্ধান্তে সুবিবেচনার পরিচয় নাই। মণ্ডপ ‘উন্মুক্ত’ রাখিয়া বা স্যানিটাইজ়ার বিতরণাদি প্রতিষেধকের আয়োজন করিয়া কোভিড ঠেকাইবার মন্ত্রপাঠ শুনিতে মন্দ নহে, কিন্তু জলে নামিয়া বেণী না ভিজাইবার গানও তো শুনিতে ভালই। লক্ষণীয়, আদালত প্রশাসনের ব্যবস্থাপত্রের নিন্দা করে নাই, কিন্তু তাহাতে কতটা কাজ হইবে সেই বিষয়ে সংশয় জানাইয়াছে। মূল প্রশ্ন ব্যবস্থাপত্রের গুণাগুণ লইয়া নহে, মূল প্রশ্ন: একটি বৎসরের জন্য কি সর্বজনীন উৎসবের আয়োজন বন্ধ রাখাই বিধেয় ছিল না? এমন ঝুঁকির কারণ তো আক্ষরিক অর্থেই এক শতাব্দীতে ঘটে নাই। শাসকরা পরিস্থিতির দায়ভাগ এড়াইতে পারেন না।
কিন্তু দায়ভাগ কথাটির অর্থ দায়ের ভাগ। সরকারের উপর সম্পূর্ণ দায় চাপাইলে অন্যায় হইবে। তাঁহাদের উপর চাপ রহিয়াছে। সমাজের চাপ, রাজনীতির চাপ। বিশেষত সঙ্ঘ পরিবারের চাপ। বিজেপি কেবল এই কোভিডের কলিকাতায় দল হিসাবে দুর্গাপূজার অভিনব আয়োজন করে নাই, দিল্লিতে পূজার সমারোহ নিয়ন্ত্রণের প্রশাসনিক উদ্যোগের বিরোধিতায় নামিয়া ক্ষুদ্র রাজনীতিতে তৎপর হইয়াছে। রাজ্য সরকার জনস্বাস্থ্যের কারণে এই উৎসব বন্ধ করিলে তাহারা ‘বাঙালির আবেগ’ মন্থনে ঘোলা জলে ঝাঁপাইয়া পড়িত— এমন অনুমানের বিলক্ষণ হেতু আছে। অন্য দিকে রহিয়াছে অর্থনীতির বাস্তব। সর্বজনীন পূজা এই বঙ্গে স্পনসর-ধন্য উৎসব-বাণিজ্যে পরিণত। রাজনীতির কারবারিরা অনেকেই তাহাতে জড়িত। আদালতের রায় ঘোষণার পরে শাসক দলের নেতাদের, এমনকি মন্ত্রীদের অনেকের নীরবতা, কথাবার্তা এবং শরীরের ভাষা বুঝাইয়া দিয়াছে, তাঁহাদের দায় কেবল জনসাধারণের আবেগের প্রতি নহে। সরকারের চালকদের অবশ্যই উচিত ছিল সমস্ত চাপের ঊর্ধ্বে উঠিয়া জনস্বাস্থ্যের প্রতি একশো শতাংশ দায়বদ্ধ থাকা। সেই কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হইয়া তাঁহারা অনুরোধ-উপরোধ ও তর্জনগর্জন করিয়া সামাল দিবার চেষ্টা করিতেছেন। সেই চেষ্টায় প্রশাসনের সহিত সম্পূর্ণ সহযোগিতা করাই এখন নিরুপায় নাগরিকদের একমাত্র কর্তব্য। সামাজিক চেতনা অনেক দূরের ব্যাপার, আপন প্রাণ বাঁচাইবার তাড়নাতেও যদি পশ্চিমবঙ্গবাসী শুধু একটি বৎসর ভিড় বাড়াইবার আবেগ দমন করিতে পারেন, দশভুজা কিঞ্চিৎ স্বস্তি পাইবেন। এই বৎসরের দুর্গাপূজা প্রত্যেক নাগরিকের নিকট একটি পরীক্ষা। আত্মসংযমের পরীক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy