Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Durga Puja 2020

ছায়াবাস্তব

কিন্তু তাহাতেই সব গোল চুকিবে কি? সমাধান অনেক সময় সমস্যা অপেক্ষাও ভয়ঙ্কর। প্রযুক্তির কল্যাণে সত্যকারের অভিজ্ঞতাকে ভার্চুয়াল পরিসরে অনেক দূর অবধি ‘নির্মাণ’ করা আজ সম্ভব।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২০ ০০:৪৭
Share: Save:

বুধবার হাইকোর্টের সংশোধিত রায় ঘোষণার পরে সর্বজনীন পূজা কমিটিগুলির এক প্রতিনিধিকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করিয়াছিলেন, ‘ভার্চুয়াল অঞ্জলি’র ব্যবস্থা হইবে কি না। তিনি উত্তর দিয়াছিলেন, এমন সম্ভাবনার কথা তাঁহারা চিন্তা করিয়াছেন, তবে কার্যক্ষেত্রে তাহা কতটা সম্ভব হইবে, বিশেষত সাধারণ ঘরের প্রবীণ সদস্যরা প্রযুক্তির সাহায্যে অঞ্জলি দিতে পারিবেন কি না, তাহা লইয়া গভীর সংশয় আছে। করোনাক্রান্ত পশ্চিমবঙ্গে দুর্গোৎসব লইয়া মহা হট্টগোলের মধ্যে এমন একটি প্রশ্নোত্তর আপাতশ্রবণ নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। কিন্তু ভাবিয়া দেখিলে বিন্দুতে সিন্ধুদর্শনের সুযোগ মিলিতে পারে। বিপজ্জনক ভিড় নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মহামান্য আদালত যে বিশদ নির্দেশ ও পরামর্শ দিয়াছেন, তাহার মধ্যেও ‘ভার্চুয়াল পূজা দর্শন’-এর কথা ছিল। বিভিন্ন পূজা কমিটি তাহার উপযোগী নানা উদ্যোগ করিয়াছে, সংবাদমাধ্যমে মণ্ডপ, আলোকসজ্জা ইত্যাদি দেখাইবার প্রচলিত ব্যবস্থা তো আছেই। এ-বারের উৎসব অনিবার্য ভাবেই অনেক বেশি ভার্চুয়াল। বস্তুত, সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াইতে এই বিষয়ে আরও অনেক বেশি উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই আলোচনার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। অঞ্জলির সূত্রে উঠিয়া আসিয়াছে অন্য একটি প্রশ্ন। একটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে কত দূর সার্থক করিয়া তোলা যায়, তাহার প্রশ্ন।

স্পষ্টতই, এই প্রশ্নের একটি মাত্রা সামর্থ্য-ভেদের, এক কথায় ‘ডিজিটাল বিভাজন’-এর। যে যাহার আপন পরিসরে বসিয়া কোনও একটি মণ্ডপে অঞ্জলি দিতে পারিবেন, এমন আয়োজন যে অসম্ভব তাহা নহে, এই পূজায় তেমন দূরাঞ্জলির নানা নজির প্রত্যাশিতও। ঠিক যেমন গত কয়েক মাসে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এমনকি তুলনায় কম সামর্থ্যের অনেক স্কুলকলেজেও ভার্চুয়াল দূরশিক্ষার আয়োজন হইয়াছে। কিন্তু সেই ধরনের আয়োজনে অনেকেই যোগ দিতে পারেন নাই অথবা যোগ দিলেও তাহার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করিতে পারেন নাই। এই অপারগতার পিছনে বহুলাংশে দায়ী অসাম্য— প্রধানত আর্থিক অসচ্ছলতা, কিন্তু তাহার পাশাপাশি অন্য নানা বৈষম্যও, যেমন পরিবারের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষের অধিকার ও সুযোগের বৈষম্য। সেই সকল বৈষম্য দূর হইলে বিভাজনের সমস্যাও অনেকাংশেই অন্তর্হিত হইতে পারে। আর, অনুশীলনের মাধ্যমে অনভ্যাসের সমস্যা যে কত দ্রুত মিটিয়া যায়, তাহার বহু নিদর্শন দৈনন্দিন জীবনে অবিরত তৈয়ারি হইতেছে, যে প্রবীণা টেলিফোনটিও ব্যবহার করিতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না তিনি দেখিতে দেখিতে আপন মোবাইলে নানা বিনোদন উপভোগ করিতেছেন। অদূর ভবিষ্যতে তিনি হয়তো নাতিনাতনিদের সহিত ভার্চুয়াল অঞ্জলির অভ্যাসটি দিব্য রপ্ত করিয়া ফেলিবেন, তাহাতেই সত্যকারের অঞ্জলির প্রসাদ অনুভব করিবেন। অভ্যাসে কী না হয়?

কিন্তু তাহাতেই সব গোল চুকিবে কি? সমাধান অনেক সময় সমস্যা অপেক্ষাও ভয়ঙ্কর। প্রযুক্তির কল্যাণে সত্যকারের অভিজ্ঞতাকে ভার্চুয়াল পরিসরে অনেক দূর অবধি ‘নির্মাণ’ করা আজ সম্ভব। এই মুহূর্তে তাহার নানা নূতন নূতন দৃষ্টান্ত রচিত হইতেছে। যেমন, খেলা নামক বিনোদনটির ক্ষেত্রে। দর্শক-শূন্য স্টেডিয়ামে খেলোয়াড়রা খেলিবেন, দর্শকরা যে যাঁহার ঘরে বসিয়া সেই খেলা দেখিবেন, খেলার বিবরণীর সঙ্গে সঙ্গে মাঠের পরিচিত ধ্বনিগুলিও প্রচারিত হইবে, বাউন্ডারি বা ওভারবাউন্ডারিতে সমবেত হর্ষধ্বনি, কেহ আউট হইলে সম্মিলিত বেদনার স্বর— বুদ্ধি ও পরিশ্রমের সমন্বয়ে এই মায়া-বাস্তব আজ সুলভ। তাহার তুলনায় মহাষ্টমীর অঞ্জলির পরিবেশ নির্মাণ তো সামান্য ব্যাপার। কিন্তু তাহাতেই সত্যকারের অভিজ্ঞতার অভাব মিটিলে আনন্দিত হইবার কারণ আছে কি? জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে মানুষের সহিত মানুষের প্রকৃত সংযোগ ছাড়িয়া যে ভাবে ভার্চুয়াল যোগাযোগের বলয় রচিত হইতেছে এবং মানুষ যে ভাবে তাহাতেই অভ্যস্ত হইয়া পড়িতেছে, সেই অভ্যাস-নির্মাণই কি গভীর দুশ্চিন্তার কারণ নহে? কোভিডের তাড়না এই ছায়াবাস্তবের দাপটকে অনেক বেশি প্রকট এবং সর্বগ্রাসী করিয়াছে বটে, কিন্তু অতিমারি দূর হইবার পরেও এই সঙ্কট হইতে অব্যাহতি মিলিবে না। বাস্তবের বদলে তাহার ছায়া সম্বল করিয়া বাঁচিবার বেদনা ভয়ঙ্কর। কিন্তু মানুষ যদি ক্রমে সেই বেদনার অনুভূতিও হারাইয়া ফেলে, তাহা আরও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। অশ্বত্থামা পিটুলিগোলা সেবন করিয়া আনন্দে নৃত্য করিয়াছিল, কারণ সে দুধের স্বাদ জানিত না।

যৎকিঞ্চিৎ

বহিরাগতদের হাতেই জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গেল রাজ্যটা। ঘরের বুলবুলি ধান খেয়ে যাওয়ার পর বর্গিদের হানার কথাই বলুন, বা সিঙ্গুর-যাদবপুর-বিশ্বভারতী, সর্বত্র বহিরাগতের উৎপাত। আর এখন তো কথাই নেই, আন্তর্জাতিক বহিরাগত করোনাভাইরাসের চক্করে গোটা পুজো বরবাদ। তবে, এই গ্লোবাল ধাক্কায় বহিরাগতের সংজ্ঞা পাল্টে সম্পূর্ণ লোকাল হয়ে গেছে। এখন পাশের পাড়ার লোকও বহিরাগত। প্যান্ডেলে তাদের উদ্দেশে থিম সং বাজছে: ‘পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যা‌ং খোঁড়া করে দেব’।

বহিরাগতদের হাতেই জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গেল রাজ্যটা। ঘরের বুলবুলি ধান খেয়ে যাওয়ার পর বর্গিদের হানার কথাই বলুন, বা সিঙ্গুর-যাদবপুর-বিশ্বভারতী, সর্বত্র বহিরাগতের উৎপাত। আর এখন তো কথাই নেই, আন্তর্জাতিক বহিরাগত করোনাভাইরাসের চক্করে গোটা পুজো বরবাদ। তবে, এই গ্লোবাল ধাক্কায় বহিরাগতের সংজ্ঞা পাল্টে সম্পূর্ণ লোকাল হয়ে গেছে। এখন পাশের পাড়ার লোকও বহিরাগত। প্যান্ডেলে তাদের উদ্দেশে থিম সং বাজছে: ‘পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যা‌ং খোঁড়া করে দেব’।

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2020 High Court Crowd Puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy