ঝাড়খণ্ডের লেখক হাঁসদা শৌভেন্দ্রশেখরের একটি গল্পের শিরোনাম, ‘এই আদিবাসী নাচিবে না’। এমন স্পর্ধিত বিদ্রোহের জন্য এক আদিবাসী প্রৌঢ়কে নিগৃহীত হইতে হয়। কিন্তু লেখক বুঝাইয়া দেন, জনজাতির মানুষদের একটিমাত্র ছাঁচে ঢালিলে বস্তুত তাঁহাদের অপমানিত করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসীদের জগৎ সম্পর্কিত প্রতীচীর একটি সাম্প্রতিক রিপোর্ট ঠিক এই কথাটিই মনে করাইয়া দিয়াছে। জনজাতির মানুষদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি বিষয়ে নানা গড়পড়তা পরিসংখ্যান এমনই বহুল প্রচারিত হইয়াছে নানা সরকারি-অসরকারি রিপোর্টে, যে বিবিধ জনজাতির মধ্যে অতি বড় পার্থক্যগুলিও নজরের আড়ালে চলিয়া যায়। শিক্ষা হইতে জীবিকা, বহু প্রশ্নেই এক তফসিলি জনজাতির সহিত অন্য তফসিলি জনজাতির পার্থক্য বিপুল। এই রাজ্যে চল্লিশটি তফসিলি জনজাতি রহিয়াছে, গড় কষিয়া তাহাদের কাহাকেও বোঝা সম্ভব নহে। এই সহজ কথাটি কেন বৃহত্তর সমাজের মনে উদয় হয় নাই? অমর্ত্য সেনের মতে, তাহার কারণ আদিবাসীদের বিষয়ে আমাদের কোনও কৌতূহল নাই। ইহার ফলে আদিবাসীদের সমস্যা দূর করিবার কাজটি আরও কঠিন হইয়া উঠিতেছে।
বুঝিবার ভুল হইবার প্রধান কারণ, পার্থক্যের দ্বারা পরিচিতির নিরূপণ। আদিবাসীরা তিরধনুক হাতে শিকার করিতে যান, মাদল বাজাইয়া নাচ করেন, অপরিমিত মদ্যপান করেন, লেখাপড়া বা রোজগারে তাঁহাদের উৎসাহ নাই, এমনই একটি চিত্র অনাদিবাসী সমাজে প্রচলিত। বাস্তব ইহাই যে, যাঁহাদের জীবনযাত্রার আধারে এমন চিত্রটি রচিত, সেই সাঁওতালরা রাজ্যের জনজাতির মাত্র সাতচল্লিশ শতাংশ। প্রতীচীর সমীক্ষায় এই বাস্তবও প্রতিফলিত হইয়াছে যে, জনজাতির শিশুদের ৯৪ শতাংশ নাম লিখাইয়াছে স্কুলে, ৯৫ শতাংশ আদিবাসী আধুনিক চিকিৎসার দ্বারস্থ হইয়া থাকেন। অধিকাংশ প্রসবও হইয়া থাকে হাসপাতালে। তাহা হইলে পার্থক্য কি নাই? আছে বইকি। আদিবাসী শিশুদের সাত শতাংশকে এক কিলোমিটারেরও অধিক হাঁটিয়া স্কুলে যাইতে হয়। তাহাদের এলাকার স্কুলগুলিতে শিক্ষক কম, শিক্ষকের অনুপস্থিতি অধিক এবং আদিবাসী শিশুদের প্রতি শিক্ষকদের অবজ্ঞাও কম নহে। সর্বোপরি ভাষার সমস্যা শিশুদের শিক্ষার পথে বাধা হইয়া দাঁড়ায়। প্রায় অর্ধেক আদিবাসী গৃহস্থালিতে ব্যবহারযোগ্য শৌচাগার নাই।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অভাবে উন্নত জীবিকাগুলি থাকিতেছে নাগালের বাহিরে, আবার অরণ্যের ক্ষয় হইবার কারণে জীবননির্বাহের পরিচিত উপায়গুলি হারাইতেছে। ফলে এক নিদারুণ দৈন্যের মুখে দাঁড়াইয়া জনজাতির বহু মানুষ। সমীক্ষায় প্রকাশ, বৎসরের কোনও একটা সময়ে দিনে দুই বেলা খাবার জোটে নাই, এমন জনজাতি পরিবার একত্রিশ শতাংশ, শবর ও লোধাদের মধ্যে ওই হার দ্বিগুণ। অথচ আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য প্রকল্প কম নাই। তবু যে অনুন্নয়ন প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রবাহিত হইতেছে, তাহার অন্যতম কারণ আদিবাসীদের সহিত বাকি সমাজের দূরত্ব, যাহা বঞ্চনা ও বৈষম্যকেই ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া প্রতিষ্ঠা করিতে চাহে। তবু, মূল সমস্যা পরিসংখ্যানের পার্থক্যে নহে। জনজাতির মানববিশ্বের সহিত অন্যদের মানসজগতের, মূল্যবোধের। উন্নয়নের বাঁধা ফর্মুলায় কাজ না হইতেও পারে। কিসে হইবে, সে প্রশ্নটি আগে করা চাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy