—ফাইল চিত্র।
এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের দিন। ৩১ অগস্ট। ঘুম থেকে উঠে ভাবছিলাম, এ বারে ঠিক কত লক্ষ সংসারের মাথায় ‘বাজ ভেঙে পড়বে’। মাথায় ঘুরছিল আগের বারের সংখ্যাটা, ৪০ লক্ষ। আর মনে পড়ছিল সে বারের নাগরিকত্ব প্রমাণের রেজাল্ট বের হওয়ার দিনে অসমের রাজ্য স্তরে প্রায় সব সংবাদপত্রে বিভিন্ন নেতাদের মিষ্টি খাওয়ানোর হাসি-হাসি মুখের ছবিটা। কিন্তু আশ্চর্য, এ বারের শেষ রেজাল্টের ফল কোনও রাজনৈতিক দলেরই আশানুরূপ হয়নি। তাই মিডিয়া ‘সেলিব্রেশনের মুড’-এ কারও ‘বাইট’ বিশেষ একটা পায়নি। কিন্তু সাধারণ মানুষদের একাংশ খানিকটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। কারণ, এ বারে সংখ্যাটা প্রায় অর্ধেক— আইনত আপাতত রাষ্ট্রহীন হয়েছেন ১৯ লক্ষের কিছু বেশি সংখ্যক মানুষ।
আশ্চর্যজনক ভাবে, কানাঘুষোয় শোনা গেছে এই ১৯,০৬,৬৫৭ সংখ্যক মানুষের তিন-চতুর্থাংশের বেশি নাকি বাঙালি হিন্দু। তাই এক দিকে এই ‘পোস্ট ট্রুথ’ জমানায় বহু দশক ধরে তৈরি হওয়া লক্ষ লক্ষ মুসলমান অনুপ্রবেশকারীর অসমে বসবাসের ‘মিথ’ মিথ্যে হওয়ার ভয়, আর অন্য দিকে শেষ পাঁচ বছরে ১,২২০ কোটি টাকা ব্যয় করে, ৫০,০০০ সরকারি অফিসার ও ৭,০০০ ডেটা এন্ট্রি অপারেটরকে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে যে ‘বিদেশি বিতাড়ন’ প্রক্রিয়া চলেছে তা ঠিক কতটা সফল হল সেটা সঠিক ভাবে আঁচ করতে না পারাই হয়তো ছিল ওই আপাত-নীরবতার কারণ।
রাষ্ট্র ও নাগরিকের পারস্পরিক সম্পর্কের সঙ্কট এবং তার থেকে তৈরি হওয়া সংঘর্ষ ইতিহাসে অচেনা নয়। বিশেষত, এই নাগরিকত্ব প্রমাণের লড়াই বিভিন্ন দেশে আমরা অনেক বার দেখেছি। তা হলে এই নিত্য হট্টগোলের বাজারে, চারিদিকের এক অদ্ভুতুড়ে দোলাচলের মধ্যে অসম বা অসমের রাজনীতি কী ভাবে আলাদা? কেনই বা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রান্তিক এই রাজ্যে এনআরসি নিয়ে ঠিক কী হচ্ছে, তা জানতে চাইছেন পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষরা? বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার আধিকারিকদের কাছ থেকেও নাকি চিঠি এসেছে।
আসলে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বক্তব্য হল, শেষ এনআরসি তালিকায় অনেক বিদেশির নাম ঢুকে গেছে। অনেকে নাকি ‘লিগাসি ডেটা’তেও কারচুপি করেছেন। আর তার ফলে প্রচুর বাঙালি হিন্দু তো বটেই, নাম কেটে গেছে অনেক ‘খিলঞ্জিয়া’ ভূমিপুত্র অসমিয়ারও। কোচ-রাজবংশী, গোর্খা, রাভাদের মতো অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষের নাম না ওঠার কথা না হয় বাদই দিলাম। তা হলে এর সমাধানসূত্র কী? সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, শেষ তালিকা বেরনোর ১২০ দিনের মধ্যে এই ১৯ লক্ষের বেশি মানুষ ৩০০টি ফরেনার্স ট্রাইবুনালের মাধ্যমে আবার আবেদন করতে পারবেন, ১০ মাসের মধ্যে ট্রাইবুনাল তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে। কিন্তু তার জন্য ডি সি অফিস থেকে ‘সার্টিফায়েড কপি অফ রিজেকশন অর্ডার’ জোগাড় করে আবার উকিল ধরতে হবে, জমা দিতে হবে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র। কিন্তু, যাঁদের কাছে আর কোনও কাগজ নেই? অথবা যা জমা করতে পেরেছিলেন আগের বারে, তা-ও ভেসে গেছে কিছু দিন আগে ভয়াবহ বন্যায়? এ সব প্রশ্নের উত্তর আপাতত কেউ জানেন না।
কিন্তু নাম-ছুট এই ১৯ লক্ষই যদি শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হন বিদেশি হিসেবে? তা হলে রাষ্ট্র এঁদের নিয়ে ঠিক কী করবে? বাংলাদেশের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ’৭১-এর পর বাংলাদেশ থেকে কেউ নাকি ভারতে যায়নি। তা হলে? অসমের মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে থেকেই এই বিতর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে বলেছেন, নাম-ছুটদের আইনি সহায়তা দেওয়া হবে। আসু সহ রাজ্যের বিভিন্ন সংগঠন এই তালিকার বিরোধিতায় নেমেছে। এনআরসি’তে ‘ইচ্ছাকৃত’ ভুলের অভিযোগ আনা হয়েছে কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলার বিরুদ্ধে। হিমন্ত বিশ্বশর্মা যেমন তালিকা তৈরির পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর আপত্তির বিশেষ কারণ: ১৯৭১ সালের আগে আসা হিন্দু বাঙালিদের শরণার্থী কার্ডকে কর্তৃপক্ষ তাঁদের আগমন/অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেননি। তিনি জানিয়েছেন, শুদ্ধ তালিকা তৈরি করার এখন দুটি উপায় আছে। এক, বর্তমান তালিকার অন্তত ২০ শতাংশ নামের ক্ষেত্রে রি-ভেরিফিকেশন করা; দুই, কেন্দ্রীয় সরকার যখন সারা দেশ জুড়ে এনআরসি প্রণয়ন করবে, সেই উদ্যোগে শামিল হয়ে নতুন করে অসমে বিদেশি-মুক্ত লিস্ট তৈরি করা।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ-এর আমলে অসমে প্রথম এই নিবন্ধন তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। তাঁর কী মত? তিনি ৫ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চিঠিতে জানিয়েছেন, এনআরসি-র ভিত্তি হওয়া উচিত ২০১৯-এর ভোটার তালিকা। গত ৬ সেপ্টেম্বর আবার ভিত্তিবর্ষ পরিবর্তনের দাবিতে অসমে ধর্মঘট হয়ে গেল আন্তর্জাতিক হিন্দু পরিষদ ও রাষ্ট্রীয় বজরং দলের ডাকে; মূল দাবি: ১৯৭১-এর পরিবর্তে ১৯৫১’কে নাগরিকপঞ্জিতে নাম তোলার জন্য ভিত্তিবর্ষ ধরে, তার পরে আসা হিন্দু বাঙালিদের অন্য রাজ্যে পাঠাতে হবে। ১৯৫১ সাল ভিত্তিবর্ষ হলে একশো শতাংশ হিন্দু বাঙালির নাম কাটা যাবে। কারণ, দেশভাগের পর ছিন্নমূল হয়ে যাঁরা অসমে এসেছিলেন তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিলেন হিন্দু।
আসলে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও প্রাদেশিকতাবাদের দড়ি টানাটানির মাঝের অবস্থানে এখন আছেন এই দলছুট, হঠাৎ একা হয়ে যাওয়া মানুষগুলো। তাঁরা আতঙ্কে আছেন। যে কোনও দিন পুলিশ এসে কড়া নাড়বে, প্রথমে নিয়ে যাবে হাসপাতালে শারীরিক পরীক্ষা করাতে, তার পর সোজা ডিটেনশন ক্যাম্পে, মানে আপাতত জেলখানায়। সেখানে আধার কার্ড, ভোটার কার্ডও কাজে আসবে না। আতঙ্কে অনেকের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে, মানুষের বাড়িতে ঠিকে কাজের মতো সামান্য আয়ের পথও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চলছে মৃত্যুমিছিল। মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। যেমন, হাইলাকান্দির ৩ নং ওয়ার্ডের গৃহবধূ সাবিত্রী রায় এনআরসি লিস্টে নাম না ওঠায় গায়ে আগুন দিয়েছেন। যে পরিবারে এক জন ‘ঘোষিত বিদেশি’, তার বাকি সদস্যদের অবস্থাও ভয়াবহ। রাষ্ট্র তাঁদের নিজস্ব অস্তিত্ব মানবে না। কিন্তু ঠিক একই যুক্তিতে যখন বলা হয়, যে পরিবারের কয়েক জন সদস্যের নাম উঠেছে, বাকিদের নাম নেই, তাঁদের সরাসরি নাগরিকত্ব দেওয়া হোক, কর্তৃপক্ষ তা মানতে নারাজ।
কোনও ধর্মীয় বা ভাষিক গোষ্ঠীকে নিশানা করে এনআরসি করাতে গেলে এমন পরিণতি অবধারিত। অসম চুক্তি বুমেরাং হয়ে অসমিয়াদের বিপদে ফেলেছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, যাকে হিন্দু নাগরিকত্ব বিল বলে বাজারজাত করা হয়েছিল, তাতে হিন্দুদের কোনও সুরক্ষা দেওয়া যায়নি, বরং অসমিয়া ভোট ব্যাঙ্কে তার প্রভাব পড়তে পারে। অসমে হিন্দু বাঙালিরা বিজেপিকে বিশ্বাস করে শেষ নির্বাচনে উজাড় করে ভোট দিয়েছিল। ভাবা হয়েছিল, এনআরসি লিস্টে নাম কাটা যাবে বাঙালি মুসলমানদের। কিন্তু শেষ অঙ্কে দেখা যাচ্ছে, চিত্র পালটে গেছে। ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোয় আটক ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’দেরও ৯০ শতাংশই নাকি হিন্দু। ভারত ও বাংলাদেশের জনসংখ্যার শেষ কয়েক দশকের তথ্য জানায়, অসম সহ গোটা সীমান্ত জুড়ে যে অনুপ্রবেশ হয়েছে, তাতে হিন্দুরা সংখ্যায় অনেকটা বেশি। হবে না-ই বা কেন? বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ঊর্ধ্বমুখী, ধর্মীয় দিক থেকেও মুসলমানরা ওই দেশে সুবিধেজনক অবস্থায়। অসমে মুসলমানদের সংখ্যাবৃদ্ধির মূল কারণ: চর অঞ্চলের বা অনুন্নত বরাকের গ্রামীণ অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি না হওয়া এবং তাঁদের অনিয়ন্ত্রিত জন্মহার।
‘ডি-ভোটার’ থেকে এনআরসি-তে উত্তরণের সময়ে এক বার বকো অঞ্চলে গিয়েছিলাম মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে। সঙ্গী ছিলেন এক রিসার্চ স্কলার, অসমিয়া হিন্দু। ভাল মানুষ, সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন, বন্ধুর হোটেলে আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু কিছুতেই মুখে উচ্চারণ করলেন না মুসলমান শব্দটা। বার বার বলছিলেন, ‘মাইনরিটি ভিলেজ’। আর আমি বোঝার চেষ্টা করেছিলাম দুই সম্প্রদায়ের মনস্তত্ত্ব, মুসলমানদের অভিবাসনের কারণ ও তার প্যাটার্ন। আদতে ময়মনসিংহ থেকে আসা এই মানুষগুলো বলেছিলেন, প্রথম থেকেই তাঁরা নির্দিষ্ট দলে অসমে এসেছেন, পুনর্বসতি গড়ার চেষ্টা করেছেন এমন অঞ্চলে, যেখানে তাঁদের চেনা কেউ থাকেন। ১৯৪৭-এর পর যাঁরা এসেছেন, এসেই সব কাগজপত্র তৈরি করে নিয়েছেন। আর সুরক্ষার জন্য ‘গেটো’ করে থাকাই শ্রেয়। হিন্দু বাঙালিদের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা ঘটেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। গাঁ-বুড়া বলছিলেন— ভারত হিন্দুদের দেশ, তাই তারা কাগজ তো পেয়ে যাবেই,ওদের ভয় নেই। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
রাষ্ট্রীয় প্রতারণার শিকার হচ্ছেন আসলে দুটি সম্প্রদায়ের প্রান্তিক অবস্থানে থাকা মানুষগুলো। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অসমে গিয়ে ঘোষণা করে এসেছেন, এক জন বিদেশিরও ঠাঁই হবে না। এনআরসি-ছুট মানুষগুলো রোজ চোখের সামনে দেখছেন, গোয়ালপাড়া জেলার মাটিয়ায় প্রায় কুড়ি হাজার একর জমির ওপর ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিদিন সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো কর্মী কাজ করে চলেছেন ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির, যাতে অন্তত ৩,০০০ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী থাকতে পারবেন। বর্তমানে অসমে থাকা ৬টি জেলের মধ্যে যে ডিটেনশন ক্যাম্পগুলো আছে, তার প্রতিটাতে ১,০০০ জন থাকতে পারেন। ক্যাম্প তৈরির ছবি ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়ায় আর আঁতকে উঠছেন সেই সব মানুষ, যাঁদের নিজের বা পরিবারের কারও নাম নেই শেষ লিস্টেও। মানবাধিকার কাকে বলে? জালিয়ানওয়ালাবাগ বা আউৎশভিট্স কি এর থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর ছিল?
ইতিহাস বিভাগ, ডায়মণ্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy