মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই
মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দু'দিনের মহার্ঘ ভারত সফর শেষ হল। সস্ত্রীক রাষ্ট্রপতি মোতেরাতে গেলেন, বক্তৃতা করলেন। সবাই ভুল উচ্চারণ নিয়ে ব্যস্ত। আমার একটুও মন্দ লাগেনি। আমরা যেন সব বিষয়ে কত ঠিক উচ্চারণ করি! কিন্তু এখানেই আমাদের সঙ্গে তাঁর মিল শেষ হয়ে যায়নি। নিজেকে নরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্তরসূরি ভাবা আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই নিভৃতে তাঁর প্রিয় বন্ধুকে বলে দেবেন যে, ‘বিবেকানন্দ’ উচ্চারণটা ঠিক করে করতে। সামনে আবার বাঙালিদের ভোটের ব্যাপার আছে।
সে যাই হোক, উচ্চারণটা এমন কিছু নয়। দুই বন্ধুর মিল অন্য জায়গায়। সেটা হল, সম্পূর্ণ কতগুলো অগভীর কথাকে অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে পেশ করার দক্ষতা। এটা সবার থাকে না। বারাক ওবামার তো ছিলই না। তিনিও ভারতে এসে রবীন্দ্রনাথ বা বিবেকানন্দের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তা এতটাই সারগর্ভ, এতই সুচিন্তিত ছিল যে আমাদের মনে হয়েছে যেন হার্ভার্ড-এর কোনও অধ্যাপক বক্তৃতা করছেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি নন।
অতীতে ভারতের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের প্রধান অভিযোগ ছিল এই যে, ভারত পরমাণু অস্ত্র প্রসাররোধ চুক্তিতে সই করেনি এবং সর্বপ্রকার আন্তর্জাতিক বাধা অগ্রাহ্য করে সমানেই পরমাণু অস্ত্রের গবেষণা চালিয়ে গিয়েছে। ভূমি থেকে ভূমি, ভূমি থেকে আকাশ মিসাইল— যথা অগ্নি, পৃথ্বী ইত্যাদি— ভারতের নিজস্ব মিসাইল গবেষণার ফল। ‘মিসাইল ম্যান’ প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম ছিলেন আমাদের নিজস্ব গবেষণার এক অগ্রদূত। এ সব কার্যক্রম মোটেই পছন্দ ছিল না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের।
আমরা শুধুমাত্র পরমাণু প্রসাররোধ চুক্তিকেই অগ্রাহ্য করিনি, নিরস্ত্রীকরণের যাবতীয় ঢক্কানিনাদকেও খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান ছিল এই যে, কোনও ভাবেই প্রথম বিশ্বের এই সব ফাঁদে পা দিয়ে আমরা স্বাতন্ত্র্য হারাব না। আমাদের বিদেশনীতি যতটা স্বাধীন, ততটাই উল্লেখযোগ্য ছিল অস্ত্রসম্ভার প্রসারের পরিকল্পনা। তবে ইরাক যুদ্ধের পর যখন রাষ্ট্রপুঞ্জ কার্যত অকেজো হয়ে পড়ল, টোনি ব্লেয়ারের ভাষায় ‘টকিং শপস্’, তখনই এত দিনের লালিত অস্ত্র প্রসাররোধ সম্পর্কিত বক্তব্য কতটা ফাঁপা এবং মিথ্যে তা বোঝা গেল।
আরও পড়ুন: কেন তাৎক্ষণিক চাওয়া, পাওয়ায় ততটা জোর দিলেন না ট্রাম্প, মোদী?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে ওই ভয়াবহতাকে দূরে সরিয়ে রাখতে এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি শান্তির শপথ নিতে ভাবনাগুলি একে অন্যের হাত ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল। পরমাণু যুদ্ধের বিপদ এড়াতে দু'টি বিপরীতমুখী ধারণার জন্ম হয়। একদিকে যেমন ‘ডেটারেন্স’ এর ধারণা, অর্থাৎ দুই শত্রু রাষ্ট্র অথবা রাষ্ট্রগোষ্ঠীর হাতেই থাকবে পরমাণু অস্ত্র। তাই দিয়ে পরস্পরকে ভয় দেখানো চলবে। কেউ যাতে না প্রথমেই সেই অস্ত্র ব্যবহার করে তার হুমকি, পাল্টা হুমকি থাকবে। এটা ঠিক যে, রাষ্ট্রসঙ্ঘ গড়া বা বিশ্বশান্তির জন্য তার আদর্শবাদী অবস্থানের সাথে এই বিষয়টি খাপ খায় না। এটি একান্ত ভাবেই ‘ঠান্ডা লড়াই’এর যুক্তি। মার্কিন বা সোভিয়েতের মধ্যে যেমন এই যুক্তি ক্রিয়াশীল ছিল, তেমনই এখনও তা সচল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। দ্বিতীয় অবস্থানটি কিছুটা তাত্ত্বিক। নিরস্ত্রীকরণ বা পরমাণু অস্ত্র প্রসাররোধ ইত্যাদির ধারণা। ভারত বরাবরই বলেছে যে, এই অবস্থান শুনতে যতই আদর্শবাদী হোক, আসলে তা বৃহৎ শক্তির দাদাগিরির সুযোগ বৃদ্ধির কৌশল। অনেকটা ‘নিজের বেলায় আঁটিসাঁটি, পরের বেলায় দাঁতকপাটি’ গোছের।
এই মুহূর্তে বিশ্বের দুই বৃহৎ অস্ত্র ব্যবসায়ী রাষ্ট্র হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়া। আমরা আপাতত রাশিয়ার বদলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নিয়েছি, বলার মধ্যে এইটুকুই। নিরস্ত্রীকরণ যে আসলে কথার ভাঁজ ছিল, সেটা তো রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প মোতেরাতেই পরিষ্কার করে দিয়েছেন। ভারতের নানা প্রশংসা ইত্যাদি করতে করতে চলে গেলেন তাঁর দেশের গুণকীর্তনে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় যা, তা হল ভারতের নানা অতীত গৌরবের কথা, স্বর্ণমন্দির, জামা মসজিদ, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ইত্যাদি বললেও একটি বারের জন্যও প্রিয় বন্ধু মোদীর আমলে ভারতের কী কী উন্নতি হয়েছে তার ধারকাছ দিয়েও গেলেন না। শৌচাগার নাই বা বললেন, আমদাবাদে অত লম্বা বস্তিঢাকা পাঁচিল দেখে একবারের জন্যও ‘স্বচ্ছ ভারত’ উচ্চারণ করা যেত। না হয় ‘সুচিন’ এর মতো কষ্ট করেই বলতেন। মজা হল, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকলেন, তখন কেবলই নিজের আমলে কত উন্নতি হয়েছে তার বর্ণনা। এটা কি প্রবাসী ভারতীয়দের প্রভাবিত করার জন্য নয়? মার্কিন রাষ্ট্রপতি কি জানেন না যে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র প্রভাবিত হয়েছিলেন মহাত্মা গাঁধীর দ্বারা? “আই হ্যাভ আ ড্রিম”— বলেছিলেন তিনি। একটি বৈষম্যমুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলেন। বাঁচতে চেয়েছিলেন। গাঁধীর মতোই বুলেট আছড়ে পড়েছিলেন। ট্রাম্প সাবরমতী আশ্রমে গেলেন। সস্ত্রীক চরকা ঘোরালেন। সেখানে মোদীর কথা বললেন, কিন্তু একবার এই ইতিহাসটিও উল্লেখ করতে পারতেন। ঠিক যেমন করেছিলেন তাঁর পূর্বসূরি বারাক ওবামা।
আরও পড়ুন: মোদী-ট্রাম্পের ব্যক্তিগত রসায়ন কি জোরাল করতে পারবে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক?
অবশ্য ট্রাম্প তাজমহলে ছবি তুলতে আসেননি। তিন বিলিয়ন (তিনশো কোটি) ডলারের ব্যবসা করতে এসেছেন। অস্ত্র ব্যবসা। নৌবাহিনীর ব্যবহারের জন্য চব্বিশটি এমএইচ-৬০ মাল্টিমিশন হেলিকপ্টার ‘রোমিও’ কিনছে ভারত। সঙ্গে ছ’টা অতিরিক্ত চপার। দেশে যতই অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড হোক, ভারত মহাসাগরে চৈনিক সাবমেরিনের গোপন অভিসারে আঘাত হানতে চলেছে এই রোমিও হেলিকপ্টার। এতে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে মার্কিন বন্ধু ভারতের আধিপত্য থাকবে। এত দিন চিনের দাপাদাপিতে কিছুটা অসুবিধে হচ্ছিল। এ বার ভারতের অর্থে তাদের ঘাড়ে চেপেই চিনকে চেপে ধরা যাবে। এই সূত্রেই পুরো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারত-মার্কিন যৌথ আধিপত্য বাড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে আপাতত মার্কিন দায়িত্ব শেষ হতে চলেছে। নতুন অস্থিরতার পরিধি বিস্তৃত করা প্রয়োজন। সুদূর প্রাচ্যে বাণিজ্যের পথ সুগম করাই লক্ষ্য।
আমাদের অবশ্য বিকল্প নেই। ভারত মহাসাগরে নিয়ন্ত্রণ কাম্য। কিন্তু নতুন অস্থিরতাও যাতে সৃষ্ট না হয়, সেটাও দেখতে হবে। তবে ট্রাম্প তাঁর বন্ধুর থেকে একটি বিষয়ে সম্পূর্ণ আলাদা দেখে ভাল লাগল। বন্ধুটি তো ‘মন কি বাত’ বলেই উধাও হয়ে যান। কিন্তু ট্রাম্প সফরের শেষে সাংবাদিকদের রীতিমতো জোরাজুরি করলেন তাঁকে প্রশ্ন করার জন্য। বললেন, ওবামাকেয়ারের কথাও। স্ট্যাচু অফ লিবার্টি হয়তো কখনও ইউনিটির থেকেও বেশি প্রাসঙ্গিক।
(লেখক বঙ্গবাসী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy