রাষ্ট্র মহান হয় কোন পরিচয়ে? জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিককে বৈষম্যহীন, নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা প্রদানে। নাগরিককেও দেখিতে হয়, রাষ্ট্র তাঁহাকে যে অধিকারগুলি দিয়াছে, সহ-মানুষটিরও সেই সব অধিকার সুনিশ্চিত কি না। নতুবা রাষ্ট্র ও নাগরিক, উভয়েই হতমান হয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ স্লোগানের ঝড় উঠাইতে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে ছুটিতেছে! সম্প্রতি এক শ্বেতাঙ্গ তরুণ এক শিখ দোকানিকে পাগড়ি টানিয়া, শ্মশ্রু ছিঁড়িয়া নিগ্রহ করিলেন, সিগারেটবিক্রেতা শিখ তাঁহার বয়সের প্রমাণপত্র দেখিতে চাওয়ায়। নাগরিক অধিকার আন্দোলনের মুখ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র সম্পর্কে খবর পড়িতে গিয়া টিভি চ্যানেলের সঞ্চালক ‘কিং’-এর পরিবর্তে বর্ণবিদ্বেষী শব্দ উচ্চারণ করিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নেওয়া এক ‘নেটিভ আমেরিকান’ ড্রাম বাজাইয়া গান গাহিয়া রাস্তায় হাঁটিতেছিলেন, একদল শ্বেতাঙ্গ স্কুলছাত্র তাঁহাকে ঘিরিয়া, অঙ্গভঙ্গি করিয়া পরিহাস ও বিদ্রুপে ভরাইয়া দিল। দর্শকদের প্রতিবাদের জেরে টিভি-সঞ্চালক দুঃখপ্রকাশ করিয়াছেন, ছাত্রদের উগ্র আচরণে লজ্জিত ক্ষুব্ধ স্কুল কর্তৃপক্ষ শাস্তিদানের কথা বলিয়াছেন। শহরের মেয়র বলিয়াছেন, সমানাধিকার ও সৌভ্রাতৃত্বের আদর্শে বিশ্বাসী তাঁহার শহরের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হইল।
সহ-নাগরিকের প্রতি নাগরিকের এই আচরণ কাম্য নহে, তাহা বলিতে যখন শাস্তিদানের দরকার পড়ে, তখন বুঝিতে হয়, সমাজরন্ধ্রপথে রোগ বহু দূর প্রবেশ করিয়াছে। যে রাষ্ট্র এককালে বহু ভাষা, বর্ণ, জাতিকে সাদরে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়াছে, বিবিধ সংস্কৃতিেক উদারতা ও সহিষ্ণুতার জলহাওয়ায় পরিপুষ্ট করিয়া মানবাধিকারের ধ্বজা উড়াইয়াছে, সেই রাষ্ট্রের নাগরিকেরাই এখন সহ-মানুষকে বলিতেছেন, আমার জাতি-পরিচয় উচ্চ, তুমি বিদেশি, বিধর্মী, অনুপ্রবেশকারী, এই রাষ্ট্রে তোমার স্থান নাই। এত কাল পরমতসহিষ্ণু নাগরিকেরা সহসা পরমতবৈরী হইয়া উঠিলেন, বিশ্বাস করা দুষ্কর। সকল দেশের সমাজেই কিছু বিদ্বেষ সুপ্ত বা প্রচ্ছন্ন থাকে, অনুকূল পরিস্থিতি পাইয়া সেই ফল্গুধারা উৎসারিত হইয়া উঠে। আগুন জ্বলিতে ইন্ধন প্রয়োজন, মার্কিন দেশেও বিদ্বেষের আগুনে কাঠকুটা জোগাইয়াছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাই যখন বলেন অভিবাসী মাত্রেই দুরাচারী, বিশেষ ধর্মের মানুষ মাত্রেই দুর্বৃত্ত, তাহা নাগরিকদের প্রভাবিত তো বটেই, প্ররোচিত করিতেও বাধ্য। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁহার স্লোগান ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’-এর ভিত্তি হিসাবে জাতি-বর্ণের কৌলীন্য প্রতিষ্ঠার কথা বলিতেছেন। বলিতেছেন, সরকার অনন্ত শাটডাউনে পড়িয়া থাকিলেও প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকোর সীমান্তে প্রাচীর তুলিয়াই ছাড়িবেন। প্রাচীর তো শুধুমাত্র স্থানিক নয়, মানসিকও। নেটিভ আমেরিকান মানুষটিকে উত্ত্যক্ত করা ছাত্রদলের মাথায় ছিল ট্রাম্পের স্লোগানলাঞ্ছিত টুপি: ‘বিল্ড দ্যাট ওয়াল!’ প্রেসিডেন্ট স্বয়ং টুইটে ছাত্রদের সমর্থন জানাইয়াছেন, নেতা ছাত্রটিকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানোর ইঙ্গিত মিলিয়াছে। রাষ্ট্র ও নাগরিকের এই রূঢ় উল্লাসের সম্মিলনে সমাজমনে সহিষ্ণুতার বহমান ধারাটি না শুকাইয়া যায়! সরকার কালে পাল্টাইবে, দক্ষিণপন্থা গিয়া অন্য মতাদর্শের পতাকা উড়িবে, কিন্তু নাগরিকদের মধ্যে বিভেদবোধ হয়তো সমাজে চিরস্থায়ী ক্ষত রাখিয়া যাইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy