Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Donald Trump

কাচের ঘরে ঢিল ছুড়ে গেলেন

আমেরিকায় ভোট জালিয়াতির প্রথম আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ১৭৮৯-এ, জর্জিয়ার কংগ্রেশনাল নির্বাচনে। ১৯৬০-এর ভোটটা আবার শতাব্দীর সবচেয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই।

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২০ ০০:৫৫
Share: Save:

সাদা বাড়িটার ছিটকিনি ভিতর থেকে বন্ধ করে ক্যাম্পাসের মধ্যে গল্ফ খেলছেন ট্রাম্প। হার মানতে গররাজি। টুইট করছেন, বিবৃতি দিচ্ছেন— ভোট গিয়েছে ‘চুরি’। আর আমেরিকান সমাজের শিরদাঁড়া দিয়ে বইছে ঠান্ডা স্রোত। কী হবে যদি ট্রাম্প দরজা না খোলেন সাদা বাড়িটার, না করেন ক্ষমতার সাবলীল হস্তান্তর! প্রথম সারির সংবাদপত্রে নিবন্ধ— রিপাবলিকান গভর্নর ও রিপাবলিকান-গরিষ্ঠ সেনেটের সাহায্যে কী ভাবে ক্ষমতায় থেকে যেতে পারেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

ট্রাম্পের কণ্ঠে বেলারুস কিংবা ভেনেজ়ুয়েলার ‘প্রতিযোগিতামূলক স্বৈরতন্ত্রী’ শাসকের বক্তব্যের অনুরণনে শিহরন আমেরিকায়। ২০১৭-র এক সমীক্ষায় অবশ্য দেখা গিয়েছে আমেরিকায় ভোটে দুর্নীতির পরিমাণ ০.০০০৯%-এর কম। ফেডারাল ইলেকশন কমিশনার এলেন ওয়েনট্র্যাব উড়িয়েছেন ডাকযোগে ভোটে দুর্নীতির অভিযোগ। আসলে দুর্নীতির সুযোগ আছে কি না, সেটাই বোধ হয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কারচুপি, এমনকি গোটা নির্বাচনটাই চুরি হওয়ার অভিযোগ করে আমেরিকান গণতন্ত্রের ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির শিকড় ধরে টান দিয়েছেন।

আমেরিকার নির্বাচনে দুর্নীতির অভিযোগ বার বার। ২০০০ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ফ্লরিডাতে জিতে প্রেসিডেন্ট হন রিপাবলিকান জর্জ ডব্লিউ বুশ। অনিয়ম, কারসাজি, দুর্নীতির অভিযোগের দাপটে ২০০০ সালের ফ্লরিডা আজ লোককথার ইতিবৃত্তে। পাঞ্চিং মেশিনে ত্রুটিপূর্ণ ছিদ্রের ফলে ভোট গোনার যন্ত্রে অগ্রাহ্য হয় প্রচুর ব্যালট। সেই থেকে ‘হ্যাঙ্গিং চ্যাড’ কথাটাই বিপুল পরিচিত। ২০০৪-এ বুশের কাছে জন কেরি-র হার নিয়েও ধোঁয়াশা। রোলিং স্টোন-এর নিবন্ধে রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র-এর অভিযোগ, রিপাবলিকানরা ওহাইয়ো-র সাড়ে তিন লাখের বেশি ভোটােরর ভোট দান ও গণনায় বাধা দিয়েছেন, যার খানিকটা পেলেই নির্বাচনটা জিততেন কেরিই! গবেষণামূলক বই প্রুভিং ইলেকশন ফ্রড-এ রিচার্ড শার্নিন না-গোনা ও ‘ভূতুড়ে ভোট’-এর হিসেব কষেছেন। ১৯৮৮, ১৯৯২, ২০০৮-এর নির্বাচনের প্রেক্ষিতেও শার্নিন দেখিয়েছেন এই ভূতের নৃত্য।

আমেরিকায় ভোট জালিয়াতির প্রথম আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ১৭৮৯-এ, জর্জিয়ার কংগ্রেশনাল নির্বাচনে। ১৯৬০-এর ভোটটা আবার শতাব্দীর সবচেয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। শিকাগোর মেয়র রিচার্ড ডেলি-র কারসাজিতে ইলিনয়-এ কেনেডির জয় নিশ্চিত হওয়ার অভিযোগ। বিতর্ক দক্ষিণ টেক্সাস নিয়েও। রিপাবলিকান-ঘেঁষা মিডিয়া শোরগোল তুললেও নিক্সন সংঘাতের মধ্যে যাননি।

ট্রাম্পের আগে পুনর্নির্বাচনে ব্যর্থ শেষ রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়র। ১৯৯২ সালে ক্লিন্টনের কাছে হেরে, পরাজয়েও বুশ দেখেছিলেন আমেরিকান ‘গণতন্ত্রের মহিমা’। এই পদ্ধতির মধ্য দিয়েই ২০১৬-য় ক্ষমতায় আসেন ট্রাম্প। পুনর্নির্বাচনের দৌড়ে হারের মুখে দাঁড়িয়ে হইচই জুড়ে ট্রাম্প দেখালেন, কত ভঙ্গুর এই ব্যবস্থা।

নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ বিনা কী হয়, আমেরিকা তার উদাহরণ। ফেডারাল ইলেকশন কমিশনের কাজ— নির্বাচনী প্রচারের অর্থ সংক্রান্ত আইন কার্যকর করা, ব্যস। দেশে ভোটের নিয়ম, গণনাপদ্ধতি ইত্যাদি রাজ্যভেদে বদলায়। এ সবের পরিচালনা রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে। ভোটের আগের দিনও চলে দেদার প্রচার। ‘আর্লি ভোটিং’ কোথাও চার দিন আগে থেকে, কোথাও ৪৫ দিন! প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা যখন জোরদার বিতর্কে ব্যস্ত, তার আগেই ভোট দিয়ে ফেলেছেন বহু মানুষ। ভোটের প্রায় ৪৫%ই হয়েছে ডাকযোগে। অতিমারির কারণে ‘মেল-ইন’ ভোট এক লাফে বেড়েছে। এ সব ভোট সংগঠনে রাজনৈতিক দলগুলির প্রভাব নস্যাৎ করা কঠিন। মোটের উপর, এ বারের নির্বাচন ‘চুরি’ নিয়ে ট্রাম্পের অভিযোগের সারবত্তা যদি না-ও থাকে, আমেরিকার নির্বাচনে অনিয়ম, দুর্নীতির পুরোটাই গল্পকথা নয়। ২০০৪-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বলেছিলেন, নির্বাচনের কিছু সাধারণ মানদণ্ড পূরণে আমেরিকা ব্যর্থ।

তবুও দেশটা দিব্য চলছিল। কারণ, পোড়-খাওয়া রাজনীতিবিদরা গণতন্ত্রের ‘মহিমা’-কীর্তনে কসুর করেননি এত দিন। এক অপ্রথাগত রাজনীতিকের ছোড়া ঢিলে চিড় ধরেছে সেই কাচের ঘরে।

১৮৮৮ সালের ভোটে ইন্ডিয়ানার রিপাবলিকান কর্মীদের দায়িত্ব দেওয়া হয় পাঁচ জন করে ফ্লোটিং ভোটারের ভোট কিনে নেওয়ার জন্য। টাকা দিয়েই। ‘ব্লক্‌স অব ফাইভ’ নামে পরিচিত সেই দুর্নীতির ফলেই কিন্তু দেশ জুড়ে চালু হয় গোপন ব্যালটে ভোটের নিয়ম। ব্যবস্থাপনার উত্তরণ হয় এ ভাবেই। আজকেও ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিন্দামন্দ করার সঙ্গেই, আমেরিকানরা যদি নির্বাচনী পদ্ধতির খানিকটা সংস্কার সাধনে মন দেন, সেটা আখেরে গণতন্ত্রেরই মঙ্গল। বন্ধ হোয়াইট হাউসের ছিটকিনি খোলার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প একটা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়ে গেলেন পুরোমাত্রায়।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

অন্য বিষয়গুলি:

Donald Trump US Presidential Election Edit
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy