অনেক ধুলো, ধোঁয়া আর আঁধারের মধ্যে দিয়ে পথ হাঁটার পর মানুষের করোনা-ভাবনার মাঠে এখন অকাল বসন্তের বাতাস। টিকার জয়যাত্রার রথের চাকার আওয়াজ শুনতে কান পেতেছেন সকলে। ফাইজ়ার, মডার্না, অ্যাস্ট্রাজ়েনেকা শব্দগুলো এখন ঘরে ঘরে। সবার এখন একটাই চাওয়া পাওয়া। টিকা কবে আসবে? কী ভাবে হাতে পাব সেই জিয়নকাঠি? মুখে মুখে ঘুরছে কোভিশিল্ড, কোভ্যাক্সিন, কোভিভ্যাক্স, স্বপ্নের রথের ঘোড়ার নামগুলো। কার জোর কত বেশি, কত আয়োজন দেশ জুড়ে চলছে তাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, এ নিয়ে সবাই মশগুল। আশাবাদ ভাল, কিন্তু মাথায় রাখা দরকার যে, শুধু আবেগের উনুনে সিদ্ধ হয়ে যদি রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক এক্কাদোক্কার ছকগুলোকে আগে দেখে না নিই— আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। জনস্বাস্থ্যের দু’কূলপ্লাবী সঙ্কটের মোকাবিলায় এত হুড়োহুড়ি ফল দেবে তো?
বিজ্ঞানের পদক্ষেপগুলো সাধারণত আবেগে মোড়া, কিন্তু সুচিন্তিত, নৈর্ব্যক্তিক, বাইরের প্রভাবমুক্ত হতে হয়। অথচ, করোনার টিকা তৈরি করতে গিয়ে যত রকমের বিজ্ঞানের বাইরের প্রভাবের ঢেউ-এর মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানীদের সাঁতরাতে হয়েছে, আজ পর্যন্ত তা কখনও দেখা যায়নি। করোনা যে দ্রুত গতিতে সারা পৃথিবীতে নিজের ঘর বানিয়েছে, সেটাও অবশ্যই বিশ্বায়িত পৃথিবীর আবির্ভাবের আগে সম্ভব ছিল না। করোনার জন্ম কোথায় তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে, কিন্তু করোনার বিকাশ যে উদ্বাহু বিশ্বঅর্থনীতির আগুনডানায় ভর করে, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। তাই রাজনীতি এবং অর্থনীতি যে নিজের ঘরের আগুন নেবাতে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে বিজ্ঞানীদের ঘাড়ের কাছে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলবে, প্রয়োজনে চাবুক মারবে, সেটা বোঝাই যায়। আর, কষ্টে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা মানুষ মুক্তি পেতে যে রাজনীতিকদেরই হাত ধরবে, সেটাও স্বাভাবিক। এই সমস্ত টানাপড়েনের মধ্যে দিয়েই বিজ্ঞানীকে বানাতে হচ্ছে টিকা। মাথায় রাখতে হচ্ছে, সেই টিকার জোরের উপর ভরসা করে দেশের পরিচালকরা যেন বুক চিতিয়ে মানুষকে সুরক্ষার ছিদ্রহীন বলয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারেন। ফলে বিজ্ঞানের প্রথাগত পদক্ষেপগুলোকে অনেক সময় দ্রুতগতিতে করতে হয়েছে। সুরক্ষার মিনারের চূড়ায় পৌঁছোনোর চেষ্টা করতে তাড়া করতে হয়েছে।
সমস্যা হল, করোনার অন্ধকার আকাশে স্বপ্ন বিক্রি করার নানা উদ্যোগ ইতিমধ্যেই আমাদের চোখে পড়েছে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই অন্তত খানকয়েক ওষুধ করোনা চিকিৎসায় যে বুজরুকিমাত্র, তাও প্রমাণিত হয়েছে। দু’কূলজোড়া কষ্টের ভুবনডাঙায় লাভের গুড় খেতে আর্থিক বিনিয়োগের হুড়োহুড়িও যথেষ্টই চোখে পড়েছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। লগ্নি পুঁজির মূলগত তথ্যের উপর দাঁড়িয়েই এই সব কিছু। কড়ি গোনার এই প্রতিযোগিতায় কল্যাণকামী রাষ্ট্রকে নজর রাখতে হয় একমাত্র মানুষের স্বার্থের দিকেই। কিন্তু রাষ্ট্রের চালকদের যে অনেক সময় ব্যবসাদাররাই চালান, তার বেলা? ব্যবসাকেও যে বুঝতে হয় মানুষ না থাকলে তার লাভের বাগানে ফল ধরবে না। ফলত, টিকার ক্ষেত্রে লাভের গুড় খাওয়ার হুড়োহুড়ি আর রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শঙ্কা জাগাচ্ছে বইকি।
টিকাকে ঘিরে এই উন্মাদনার আবহে আরও একটি ভাবনা ক্রমশ পিছু হটছে। তার থেকে সমস্যার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সামাজিক শৃঙ্খলা, ব্যক্তিগত জীবনধারার যে পাল্টে যাওয়া রীতিগুলো এত দিনের করোনা প্রতিরোধের পথ হেঁটে রপ্ত হয়েছিল, তা গুরুত্বহীন হয়ে পড়লে নতুন ধাক্কা লাগবে না তো? যে অস্ত্রের উপর ভরসা করে আমরা সব ভোলার চেষ্টা করছি, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ছোট্ট অঙ্গনে তা অবশ্যই আশা জাগাচ্ছে। কিন্তু যত দিন না পর্যন্ত ব্যাপক সংখ্যক মানুষের উপর তার প্রয়োগ হচ্ছে, তত দিন চোখ বুজে তার শক্তির উপর ভরসা করার ভাবনায় বিজ্ঞানের থেকে অন্ধবিশ্বাস বেশি।
আরও একটা শঙ্কার ভিত্তি হচ্ছে আরএনএ ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা তৈরির উপযোগিতায় এত দিন এতটা সাফল্য দেখা যায়নি। অথচ, করোনা ভাইরাস এই গোত্রেরই। বিজ্ঞানীরা করোনা টিকা উদ্ভাবনে যে পদ্ধতি প্রকরণ ব্যবহার করেছেন, তাতে অবশ্যই চমকে উঠতে হয়, সেলাম ঠুকতে হয়। কিন্তু আবারও মনে জাগে সেই শঙ্কার কথা। বোতাম টিপে, মুহূর্তের আনন্দে জ্বলে ওঠা বিজ্ঞানের আলো সময়ের পথ বেয়ে হাঁটার পরই বোঝা যায় তা কতটা বলশালী। আর এখানে তো জড়িয়ে আছে হাজার কোটি মানুষের জীবন।
কে আগে টিকা পাবেন, কী ভাবে পাবেন, কত দামে পাবেন এই প্রশ্নগুলোর এখনও উত্তর নেই। এর মধ্যেও মাথায় রাখা ভাল, করোনা কিন্তু এখনও পর্যন্ত ঝড় তুলেছে শহুরে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের জীবনে। গ্রামে থাকা বিরাট অংশের মানুষ কিন্তু এখনও মনে করেন করোনা তাঁদের জীবনের সমস্যা নয়, শহরের বাবুদেরই সমস্যা। টিকার প্রয়োগের সামাজিক ক্ষেত্র ঠিক করতে গিয়ে গ্রামের মানুষের এই অনাগ্রহ ও বিপরীত ভাবনার সঙ্গে শিক্ষিত নাগরিক মনের ভাবনার এই ফারাকটা কিন্তু সঙ্কটময় হয়ে উঠতে পারে। একশো তিরিশ কোটি মানুষকে সরকার বিনিপয়সায় টিকা পৌঁছে দেবে, এটা ভাবাই মুশকিল। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে, সরকারের আর্থিক সঙ্গতি অনুযায়ী টিকার বিলি বণ্টনের বাইরে বিস্তৃত পরিসরটি কিন্তু টিকা ব্যবসায়ের খোলা আঙিনা হয়ে বসে থাকবে। তাই টিকার স্বপ্নে বিভোর হলে প্রান্তিক মানুষের আর্থিক ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা।
বহু প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত। তাই আনন্দের আতিশয্যে ভেসে না যাওয়াটাই মঙ্গলের।
সচিব, লিভার ফাউন্ডেশন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy