তখন প্রাইমারিবেলা। টিফিনের ঘণ্টা পড়ার একটু আগেই শুনতে পেতাম সাইকেলের ঘণ্টি। আর তার পরেই পাউরুটির সুগন্ধে ভরে যেত গোটা স্কুল। ছুরিতে সেই পাউরুটি কেটে ভাগ করে দিতেন শিক্ষকেরা। তার পরে শুরু হত ‘এক্সপেরিমেন্ট’। কেউ বাড়ি থেকে নিয়ে আসত চিনি। কেউ আবার পাউরুটি নিয়ে সটান হাজির হত স্কুলের কলতলায়। পাউরুটি ভিজিয়ে খাওয়ার নাকি স্বাদই আলাদা! শ্যামল, বিমল, হাসান, কিশোর, মজিবরদের হইহই, টিফিন কাড়াকাড়িতে কী ভাবে যে সময়টা ফুরিয়ে যেত, টেরই পেতাম না।
আর সারা বছরের টিফিন পিরিয়ডের টুকরো আনন্দ সুদে-আসলে ফিরে আসত সরস্বতী পুজোর সময়। দলবেঁধে সেই হুল্লোড়, খিচুড়ি খাওয়ার দিন মনের আঙিনায় আজও অমলিন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে ফের ঢুকে পড়েছি সেই স্কুলেই। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে থাকতে থাকতেই প্রতিদিনই খুঁজে পাই আমার স্কুলবেলা। এ ভাবেই চলছে।
তবে তাল কাটল দিনকয়েক আগে সংবাদমাধ্যমে আহিরণের রামডোবা মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রের খবর দেখে। ওই স্কুলের পড়ুয়াদের ধর্মের নামে আলাদা পাত পড়ে! বসার জায়গা, রান্না এমনকি রাঁধুনিও আলাদা! মিডডে মিলের এমন ব্যবস্থা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই মুর্শিদাবাদ, এই সংস্কৃতি আমার কাছে একেবারে অচেনা। এ থেকে উত্তরণের পথ আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে।
মিডডে মিল অত্যন্ত কার্যকরী ব্যবস্থা সেই সব দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য যারা গরম ভাত খেয়ে স্কুলে আসতে পারে না। যাদের দুপুরে পেট পুরে ভাত জোটে না। যাদের খাবারের জন্য পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য হয়। বিদ্যালয় হল পৃথিবীর সেই পবিত্রতম জায়গা যেখানে পড়ুয়ার কোনও জাত-ধর্ম-বর্ণ দেখা হয় না। তার একটাই ধর্ম ও পরিচয় হল সে এক জন পড়ুয়া। সব ছাত্রছাত্রীই সমান। কে বড়লোক, কে গরিব, কে কোন ধর্মের সেটা বড় কথা নয়। আর সেই কারণেই সমস্ত ছাত্রছাত্রীর পোশাক, বসার জায়গা, খাবার সব এক। বিদ্যালয়ের কাজই হল ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই বোধ নিয়ে আসা যে, ‘আমরা সবাই সমান। আমাদের মধ্যে নেই কোনও ভেদাভেদ। আমরা পরস্পরের বন্ধু। এবং আপদে-বিপদে সবাই সবার পাশে দাঁড়াব।’ এই সাম্যের অভ্যাস তৈরিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে মিডডে মিল ব্যবস্থা। যেখানে গরিব, বড়লোক, হিন্দু, মুসলিম, দলিত সবাই একসঙ্গে একই খাবার খায়। মানুষের ধর্মবিশ্বাস, ভৌগোলিক পরিবেশ এবং রুচি অনুযায়ী খাদ্যাভ্যাস তৈরি হয়। কিন্তু মিডডে মিল তো সর্বজনীন। গোটা বঙ্গের জন্য যে ব্যবস্থা, মুর্শিদাবাদের বিদ্যালয়ের জন্য তাই। সমস্ত পড়ুয়া একসঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিয়ে বা পাশাপাশি বসে মিডডে মিল খায়। নিজেদের অজান্তেই ওরা গায় সাম্যের গান। বৈচিত্র্যময় ভারত মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
হিন্দু, মুসলিম-সহ সব সম্প্রদায়ের মহিলারা মিডডে মিল রান্নার কাজে যুক্ত। তাঁরা সেই খাবার রান্না করেন সকলের জন্য। খাবারের কোনও জাত হয় না। ফলে বিদ্যালয়ে সেই খাবার নিয়ে জাতপাত ঢুকে পড়বে, ছেলেমেয়েদের মন বিষিয়ে দেবে, গ্রামের লোকজন জেনে বা না জেনে সেটা দিনের পর দিন প্রশ্রয় দিয়ে যাবেন— এটা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
বিদ্যালয় থেকে অর্জিত শিক্ষাই আমাদের শিক্ষা পরবর্তী বৃহত্তর জীবনে চলতে সাহায্য করে। কিছু ঘটনা কচি মনের গভীরে দাগ কাটে যা চিরকাল অবচেতন মনে থেকে যায় এবং সেই ভাবে তাঁকে জীবনে চলতে সাহায্য করে। ভাল ঘটনা বা পরিবেশ যেমন তাদের সুন্দর ব্যক্তিত্ব গড়তে সাহায্য করে ঠিক তেমনই খারাপ ঘটনারও প্রভাব পড়ে তাদের ব্যক্তিত্বে।
এখন প্রশ্ন হল, মিডডে মিল নিয়ে কিছু লোকের ভুল ভাবনার কাছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাথা নোয়াবেন কেন? স্কুল কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল, এলাকার অবুঝ অভিভাবকদের বোঝানো আমাদের দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে। হয়তো স্কুল কর্তৃপক্ষ চেষ্টাও করেছেন এবং অল্পেই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। বিদ্যালয়ের কাজই হল, মনের অন্ধকার দূর করে পড়ুয়াদের মনে আলো নিয়ে আসা। যা কিছু অস্বাস্থ্যকর এবং অবমাননাকর তা বর্জন করা। সবাইকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমেই এই ধরনের সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। মিডডে মিল নামক বিদ্যালয়ের এক অসাধারণ সর্বজনীন ব্যবস্থাকে কোনও মতেই দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না।
প্রধান শিক্ষক, লস্করপুর হাইস্কুল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy