ছবি: সংগৃহীত
সেই দিনগুলো এখনও ভুলতে পারেন না, বয়স তখন চোদ্দো, বন্ধুবান্ধব আর গানের ব্যান্ড পোল্যান্ডে ফেলে চলে আসতে হল ইংল্যান্ডে। ‘একটা শব্দও ইংরেজি বলতে পারতাম না’, বলছিলেন পাওয়েল পাওলিকোস্কি। ষাট-সত্তর দশকের সন্ধিক্ষণের ছেড়ে-আসা দেশ আর সমাজতন্ত্রের শাসন, আজও তাড়া করে ফেরে তাঁকে। বাবা আগেই দেশ ছেড়েছিলেন, ঠাকুমা ছিলেন ইহুদি, নাৎসিরা মেরে ফেলেছিল তাঁকে। মায়ের সঙ্গে যখন ইংল্যান্ডে যান, পাওয়েল ভেবেছিলেন ছুটি কাটাতে গিয়েছেন, পরে বোঝেন ওটা দেশান্তর।
অক্সফোর্ডে সাহিত্য ও দর্শনের পাঠ নেওয়া পাওয়েল এখন দুনিয়া-কাঁপানো চলচ্চিত্রকার, ছ’বছর আগে তাঁর ‘ইডা’ অস্কার (সেরা বিদেশি ছবি) পাওয়ার পর ‘কোল্ড ওয়র’-এর (সঙ্গের ছবি) সূত্রে গত বছর কান-এ সেরা পরিচালক। দুটো ছবিতেই ফিরে গিয়েছেন সোভিয়েট শাসনাধীন পোলিশ পিপলস রিপাবলিক-এ। বলেছেন, তাঁর বাবা-মার ক্ষতবিক্ষত প্রেম আর দেশান্তরি জীবন ছায়া ফেলেছে ছবিটিতে। তাঁর মতে, এ-ছবি যত-না কাহিনি, তার চেয়েও অনেক বেশি ইতিহাস।
অদ্ভুত ইতিহাস। বাবা-মায়ের আদলে-দু’টি চরিত্রের উপর দাঁড় করিয়েছেন ছবিকে। ভিক্টর আর জুলা। সঙ্গীতময় জীবন ১৯৪৯-এ শুরু। পিয়ানোয় সুর তোলে ভিক্টর, গান গায় জুলা, নাচেও দারুণ। পাগলের মতো পরস্পরকে ভালবাসে তারা, আর পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় এ-দেশ থেকে ও-দেশ। পালিয়েও রেহাই পায় না ভিক্টর, যুগোস্লাভিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সিক্রেট পুলিশ নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয় তাকে, পোল্যান্ডের চোখে সে দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক। শেষ বার যখন দেশে ঢোকে, জেলে যেতে হয়। তাকে ছাড়ানোর জন্য পোল্যান্ডে নিজের সঙ্গীত দলের ম্যানেজারকে বিয়ে করে পুত্রসন্তান উপহার দিতে হয় জুলাকে। প্রায় ভগ্নস্তূপ, বাতিল এক চার্চে নিয়ে গিয়ে ভিক্টরকে বিয়ে করে জুলা, তার পর যৌথ আত্মহত্যার প্রস্তুতি নেয়।
দেশহারা ঘরছাড়া ছিন্নবিচ্ছিন্ন প্রেমের পিছনে লুকিয়ে থাকে প্রতারক ইতিহাস। পোল্যান্ডের মতো পূর্ব বা মধ্য ইউরোপের যে-যে ভূখণ্ডে নাৎসি-শাসন সক্রিয় ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তাদের অনেকগুলির দখল নিল লাল ফৌজ। আর তার পরে— ঠান্ডা যুদ্ধে দ্বিখণ্ডিত দুনিয়ায় এই সব দেশ আর জাতি যে-রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হল, সেখানে সমাজতন্ত্রের প্রায় পুরোটাই ছিল আরোপিত। যাঁরা তা মেনে নিতে পারেননি, তাঁদের কাছে এই আরোপ হয়ে উঠেছিল আর এক শৃঙ্খল।
টুকরো টুকরো সাদাকালো ইমেজে এই ইতিহাস জেগে থাকে ছবি জুড়ে। সেই আবছায়া, সেই অগন্তব্য, সেই নির্বাসন, সেই পরিচয়হীনতা, সেই রাষ্ট্র। ১৯৬৪-তে ছবি শেষ করে দেন পাওয়েল, বাবা-মা অবশ্য বেঁচে ছিলেন আশির দশকের শেষ অবধি, যদিও পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েট-শাসনের অবসান দেখে যেতে পারেননি তাঁরা।
গোয়ায় গত বছর কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসব ‘ইফি’তে ছবিটা দেখেছিলাম, নভেম্বরে। নভেম্বর রুশবিপ্লবের মাস। আজও যাঁরা স্বপ্ন দেখেন কমিউনিস্ট পার্টির হাতে মানুষের ক্রমমুক্তি ঘটবে, তাঁরা যেন এই মাসটা এলেই একটু চনমনে হয়ে ওঠেন। ভুলে যান, মানবমুক্তির সঙ্কল্প নিয়ে যে পার্টির জন্ম, ক্ষমতাসীন হলেই সে-পার্টির হাতে লঙ্ঘিত হতে থাকে মানবাধিকারের প্রাথমিক শর্তগুলি। আবেগমথিত হয়ে যাঁরা এখন এ-দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সূচনালগ্নের শতবর্ষ উদ্যাপন করছেন, তাঁরা খেয়াল রাখবেন, ক্ষমতায় জাঁকিয়ে বসা কমিউনিস্ট পার্টির দাপটে এখানকার সাধারণ স্বাধীনচেতা মানুষ কী ভাবে এক সময় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। আর সোভিয়েট ইউনিয়ন, তার নিয়ন্ত্রণে থাকা পোল্যান্ড-সহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি, এমনকি চিন— তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা বার বার মানবাধিকার ধ্বংসের হাতে-নগদ প্রমাণ হাজির করেছে গোটা বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস জুড়ে।
শিল্পীরা আক্রান্ত হন সবচেয়ে বেশি, রুদ্ধ হয় তাঁদের স্বাধীন স্বর। ‘কোল্ড ওয়র’-এ ছেয়ে আছে তারই চিহ্ন। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের সন্ধিক্ষণ, মাজ়োবসা— লোকশিল্পীর দল মাতিয়ে দিচ্ছে পোল্যান্ড। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটার মানুষজনের মধ্যে থেকে উঠে-আসা শিল্পগুণসম্পন্নরা তালিম নেওয়ার পর অনবদ্য নৃত্যগীতে জনপ্রিয় করে তুলছেন দেশজ শিল্পকলা। পাওয়েলের ছবিতে দলটির নাম ‘মাজ়ুরেক’। ১৯৫১-য় ওয়ারশ’-তে মাজ়ুরেক-এর পারফরম্যান্স-এর পর সে দলের দুই শিক্ষক ভিক্টর আর ইরেনা-কে প্রশাসনিক কর্তা ডেকে বললেন: পরের অনুষ্ঠানে ঢুকিয়ে দিতে হবে শ্রমিক শ্রেণির অধিনায়ককে নিয়ে গান, সঙ্গে কৃষিসংস্কারের কর্মসূচি আর বিশ্বশান্তির প্রচার। ইরেনা শান্ত ভাবে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ও খারিজ হয়ে যান, তখনকার মতো মেনে নিয়ে টিকে থাকেন ভিক্টর। পরের অনুষ্ঠানে মঞ্চে কমরেড স্তালিন-এর ছবির সামনে মাজ়ুরেক-এর অসামান্য পারফরম্যান্স, শুধু ধুয়োর মতো একটা লাইন গানে ঘুরেফিরে আসতে থাকে এ বার: ‘বাই দ্য পিপলস অব স্ট্যালিন’।
পোল্যান্ডের অধিবাসীদের খুব পছন্দ হয়েছে ‘কোল্ড ওয়র’, সম্ভবত দেশান্তর/ নির্বাসন-এর সঙ্গে নিজেদের কোথাও মেলাতে পারছেন তাঁরা। তাঁদের বড় একটা অংশই একদা ‘হিউমিলিয়েটেড বাই একজ়াইল’— মনে হয়েছে পাওয়েলের। এ যেন ইতিহাসের কালানুক্রম থেকে হারিয়ে যাওয়া, একা মানুষের নিজের কাছেও আরও একা হয়ে যাওয়া... ‘আমার মুখে অন্তহীন আত্মলাঞ্ছনার ক্ষত/ আমার বুকে পালানোর পালানোর আরো পালানোর দেশজোড়া স্মৃতি।’ (শঙ্খ ঘোষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy