একান্তে আপনার সঙ্গ কামনা করে নানা নম্বর থেকে এসএমএস পাচ্ছেন কি? কিংবা টাক মাথায় চুল গজানোর সহজ উপায়ের বিজ্ঞাপন? যাঁরা ইমেল ব্যবহার করেন, তাঁরা নিশ্চয়ই পাচ্ছেন ফাঁপরে-পড়া মানুষের কাতর আবেদন, সাহায্যের জন্য। নয়তো গৃহঋণ, ‘টুর প্যাকেজ’-এর বিজ্ঞাপন। কখনও ভেবেছেন, কেন এ সব আসছে? আপনার কাছেই কেন আসছে? ভারত-সহ গোটা বিশ্বে তথ্য (ডেটা) নিয়ে যে বিশাল খেলা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, অবিরাম ‘স্প্যাম’ মেল তার এক ক্ষুদ্র অংশ। যখনই আপনি একটা লিঙ্ক-এ ক্লিক করছেন, এমনকি কম্পিউটার মাউস নাড়িয়ে স্ক্রিনে তির চিহ্নটিকে ঘোরাফেরা করাচ্ছেন কোনও লিঙ্কের উপর, তখনই আপনার সেই ব্যবহার রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। ধারাবাহিক তথ্যের বিশ্লেষণ করে বার করা হচ্ছে আপনার অভিরুচি, চাহিদা। তা বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানিকে, যাতে তারা ঠিক ক্রেতাকে ‘টার্গেট’ করে বিজ্ঞাপন করতে পারে। (তা সত্ত্বেও যে প্রায়ই বিজ্ঞাপন মোটেই ‘টার্গেট’-এ লাগে না, সেটা এই মতের প্রবক্তারা এড়িয়ে যেতে চান।)
এই যে দ্রুত বেড়ে-চলা ডিজিটাল-তথা-ডেটা অর্থনীতি, তা নিয়ে এ বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষা একটা গোটা অধ্যায় লিখেছে। যার নাম, তথ্য যখন সর্বজনীন বস্তু (ডেটা অ্যাজ় পাবলিক গুড)। প্রণেতাদের যুক্তি, ডিজিটাল দুনিয়ায় ব্যক্তির বিচরণের যে ‘পদচিহ্ন’ থেকে যায়, তা ক্রমশ বাড়ছে। অর্থনীতিতে তাকে কাজে লাগানোর সুযোগ হারানো উচিত নয় সরকারের, কিংবা বেসরকারি সংস্থাদের। প্রণেতাদের প্রস্তাব, সরকারের কাছে যে তথ্য আছে, তা বিক্রি করুক। সেই সঙ্গে, বিভিন্ন ধরনের তথ্যের সংযুক্তিকরণ করুক। তথ্য সংগ্রহের যে বিকেন্দ্রিত ব্যবস্থা এখন চালু রয়েছে, তাকে এই সম্ভাবনার রূপায়ণে ‘বাধা’ বলে দেখা হচ্ছে। তাঁদের সুপারিশ, বিভিন্ন ধরনের তথ্য পরস্পর সংযুক্ত করতে হবে, (ধরে নিতে হবে, আধার নম্বর ব্যবহার করে) যাতে তথ্যভাণ্ডারের পূর্ণ সদ্ব্যবহার হয়।
অর্থনৈতিক সমীক্ষার একটি উদাহরণ: রিপোর্ট বলছে, জনধন অ্যাকাউন্ট থেকে ‘ক্রেডিট স্কোর’ (কে কত টাকা ঋণ পাওয়ার যোগ্য) কষে বার করা যাবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, কী করে তা সম্ভব? জনধন অ্যাকাউন্টের তথ্য থেকে ঋণ শোধের ক্ষমতা জানা যাবে কী করে? কিন্তু আপাতত সে প্রশ্ন না-হয় থাক। রিপোর্ট প্রস্তাব করছে, একশো দিনের কাজের প্রকল্পের তথ্যকে যদি জোড়া যায় জনধন অ্যাকাউন্টের তথ্যের সঙ্গে, তা হলে বোঝা যাবে কোন কোন জেলা বা পঞ্চায়েত এলাকায় আর্থিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তা হলে সেই সব জায়গায় ঋণ দেওয়া যাবে। প্রশ্ন হল, যে এলাকায় আর্থিক সঙ্কট চলছে (যার ফলে এলাকার মানুষের ক্রেডিট স্কোর কমা স্বাভাবিক), সেখানে কে ঋণ দিতে যাবে? কী শর্তে দেবে? ঋণ দিলে তার কী ফল প্রত্যাশিত? ঋণখেলাপি মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি? ঋণদাতা ও গ্রহীতার উপর আরও বেশি আর্থিক চাপ?
সমীক্ষার এই অধ্যায়টি আসলে পড়া দরকার যা বোঝার জন্য তা হল, কী ভাবে বিভ্রান্তি আর শঠতা ছড়ানো হয়। যা ইতিমধ্যেই জানা রয়েছে, তাকে সাবধানে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন রিপোর্ট-প্রণেতারা, যেন সেখানে পা পড়লেই বিস্ফোরণ হবে। নজর রাখা হয়েছে শুধুমাত্র সেটুকুর উপরে, যা লাভজনক হতে পারে। সামান্য লাভকেও অনেক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে, এবং তার যে সব অংশ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, প্রশ্ন রয়েছে, সেগুলো স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
প্রণেতাদের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব অন্য প্রসঙ্গেও বোঝা যায়। যেমন, তথ্যের নিরাপত্তা বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বিকেন্দ্রিত, পৃথক ভাবে সংরক্ষিত তথ্যভাণ্ডারই পছন্দ করেন। তাকে তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখার প্রথম শর্ত বলে মনে করেন। এখানে পৃথক রাখাকে ‘বাধা’ বলে দেখা হচ্ছে। তেমনই, সর্বজনীন তথ্য আর ব্যক্তিগত তথ্যের পার্থক্য বজায় রাখছে না এই রিপোর্ট। কিছু তথ্য হয়তো বিক্রি করা যেতে পারে, যেমন সড়ক, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি। কিন্তু ব্যক্তিগত তথ্য (জন্মের দিন, মোবাইল নম্বর, ঠিকানা) বিক্রি করা তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তা ব্যক্তিকে বিপন্ন করে। কারণ তাঁর পরিচয় ব্যবহার করে প্রতারণা সহজ হয়, তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নিরাপত্তা ব্যাহত হয়।
এই রিপোর্ট এমন এক কল্পজগৎ তৈরি করেছে, যেখানে তথ্য সংগ্রহ করলেই পরিষেবার সব ফাঁক বুজে যাবে, সব সমস্যার সমাধান হবে। রিপোর্টের সুপারিশ, যদি কোনও স্কুলে একটা টয়লেট কাজ না করে, তা হলে ওই এলাকার স্কুলগুলির ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক সাপ্তাহিক রিপোর্ট থেকে তা জানতে পারবেন, যাতে ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ করা যায়।
বাস্তব জগৎটা একটু আলাদা। সেখানে ওই আধিকারিকের পদ ফাঁকা থাকে, কিংবা টয়লেট সারানোর টাকা থাকে না, কিংবা ওই শিক্ষাকর্তার কাজের তদারকি করার মতো কাউকে মোটেই খুঁজে পাওয়া যায় না।
সবচেয়ে বড় কথা, তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে যে প্রশ্নগুলি সবচেয়ে বিতর্কিত, সেগুলিকে অতি হালকা ভাবে ছুঁয়ে গিয়েছে অর্থনৈতিক সমীক্ষা। তথ্যের সুরক্ষা এবং ব্যক্তিগত তথ্যের নিভৃতি বজায় রাখার আইন, এ দুটোর কোনওটাই এখনও ভারতে তৈরি হয়নি। রিপোর্ট কিন্তু ধরেই নিচ্ছে যে এগুলো হয়েই রয়েছে, এবং এগুলোতে কোনও খামতি নেই। আধারের ক্ষেত্রে সরকারের কাজের যে নজির, তা অবশ্য অন্য কথা বলে। আইন থাকলেও ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষিত থাকে না। উপরন্তু, ভারতে এই আইনের রূপায়ণ নানা বাধার সম্মুখীন হবে, কারণ এখানে ডিজিটাল প্রযুক্তি সম্পর্কে খুব কম লোকই জানেন, আইন সম্পর্কে সচেতনতাও কম। সেই সঙ্গে রয়েছে দীর্ঘ সামাজিক বৈষম্য, যা সরকার বা কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে ক্রেতা তথা নাগরিকের সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলবে। তা সমানে-সমানে সম্পর্ক হবে না, ক্ষমতার বৈষম্য তাকে অসম সম্পর্ক করে তুলবে।
যেখানে আইন তৈরি হয়ে গিয়েছে, সে সব দেশও কর্পোরেটদের তথ্য চুরির প্রবণতা রুখতে হিমশিম খাচ্ছে। ফের মনে করুন ক্রেডিট স্কোর-এর ভিত্তিতে ঋণদানের উদাহরণটি। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, তথ্য বিশ্লেষণের পদ্ধতি (অ্যালগরিদম) এমন অন্যায় ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যে যাঁরা বিশেষ ভাবে বিপন্ন, তাঁদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে। যেমন, যে কৃষ্ণাঙ্গ মহিলারা একক ভাবে সন্তান মানুষ করছেন, তাঁদের ইন্টারনেটে নানা জিনিসের সন্ধান (‘সার্চ হিস্ট্রি’) ব্যবহার করে গৃহঋণ বা শিক্ষাঋণ দেওয়া হচ্ছে। যদিও বোঝাই যাচ্ছে যে, তাঁদের ঋণ শোধ করার সম্ভাবনা খুবই কম। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, ডিজিটাল তস্করতন্ত্র ধনী প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে সুযোগ করে দিচ্ছে দরিদ্র মানুষদের তথ্য ‘খনন’ করে (বস্তুত চুরি করে, কারণ তাঁদের তথ্য যে গ্রহণ ও ব্যবহার হচ্ছে, তা দরিদ্ররা জানেন না) মুনাফা করতে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা কেবল যে সরকারকে সেই চৌর্যবৃত্তিতে উৎসাহ দিচ্ছে তা-ই নয়, এই তস্করতন্ত্রে ভারতকে যোগ দিতে বলছে। এক ভয়ানক অন্যায় ব্যবস্থার সুপারিশ করছে অর্থনৈতিক সমীক্ষা, যা আমাদের গভীর ভাবে আহত না করে পারে না।
আইআইএম (আমদাবাদ)-এ অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy