বিদ্যাসাগর চিরজীবী। সে দিন তাঁর ‘বর্ণপরিচয়’ আবার নতুন করে পড়লাম। ঝালিয়ে নেওয়া গেল বখাটে ভুবনের গল্পটি। আমরা কেউ তা ভুলিনি। তবু একটু ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বলি। মাসির কাছে বড় হওয়া মা-বাপ মরা ভুবন ছোটবেলা থেকেই চুরিবিদ্যা রপ্ত করেছিল। কেউ তাকে শুধরে দেয়নি। অবশেষে চুরির ভার জমতে জমতে আদালতে তার ফাঁসি সাব্যস্ত হল। ভুবনের অন্তিম ইচ্ছায় তার মাসি দেখা করতে এলেন এবং তখন তাঁর কান কামড়ে ছিঁড়ে দিয়ে ভুবন বলল, ‘‘মাসি, তুমিই এই ফাঁসির কারণ। যদি তুমি আমাকে যথাসময়ে শাসন করতে, তা হলে আজ আমার এই পরিণতি হত না।’’
আজকের পরিপ্রেক্ষিতে ভুবন-কাহিনিটি বড় প্রাসঙ্গিক। এমন অনেক সামাজিক অপরাধ হয়, গোড়ায় শক্ত হাতে লাগাম ধরলে যা সহজে সামলানো সম্ভব। বিষ বহু দূর ছড়িয়ে পড়লে চিকিৎসা কঠিন। রাতারাতি নিরাময় হবে, ভাবাও তখন বাস্তবোচিত হয় না। বরং দিশাহারা হাল হয়।
যেমন ঘটছে ‘কাটমানি’ নিয়ে। তৃণমূল লোকসভা ভোটে ধাক্কা খাওয়ার পরে ‘আত্মসমীক্ষা’ করার সুবাদে এখন এই শোরগোল উঠেছে। যার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন তৃণমূলের দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। আবার পরিস্থিতি সামলাতে দলকেই বিবৃতি দিয়ে বলতে হচ্ছে, তাদের ৯৯.৯৯ শতাংশই সৎ।
এই সব সংখ্যাতত্ত্বে অবশ্য সাধারণ মানুষের আগ্রহ কম। কারণ তৃণমূলের কাউন্সিলর, পঞ্চায়েতের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের নেতাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যে দীর্ঘদিন ধরে তোলা এবং কাটমানির রাস্তায় করে খাচ্ছেন, সেটা তো আজ কোনও নতুন আবিষ্কার নয়। এটা বোঝাতে গেলে বাজি ধরারও দরকার নেই। ভূরি ভূরি উদাহরণ এবং লক্ষণ চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় মানুষ দেখতে পান এঁদের ফেঁপে ফুলে ওঠা। এখন অবস্থার ‘চাপ’-এ বিষয়টি সামনে চলে আসার পরে বরং উল্টে প্রশ্ন উঠতে পারে, এত দিন কি এই কাটমানি-তোলাবাজিতে ‘নীরব’ প্রশ্রয় ছিল?
দল যে ব্যাখ্যাই দিক, কলকাতা-সহ জেলাগুলিতে এমন অনেক কাউন্সিলর ও পুর-কমিশনার আছেন, এলাকায় কারও বাড়ির সামান্য বাথরুম সারানো হলেও যাঁরা হুমকি দিয়ে হাত পেতে দাঁড়ান। নতুন নির্মাণ হলে তো কথাই নেই! কাউন্সিলর হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই তাঁদের দামি গাড়ি, এক বা একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট (নিজের নামে বড় একটা নয়) হতে থাকে। তাঁদের কারও ছেলে, কারও ভাই, কারও স্বামী এলাকায় ‘ডন’ হয়ে ওঠেন। কোনও কোনও কাউন্সিলর তো পুরসভার সম্পত্তিতেই নিজের ভোগদখলের অধিকার কায়েম করে নিয়েছেন, অকুতোভয়ে।
যাঁরা এ সব করেন, তাঁরা বেশির ভাগই দলে পুরনো। এঁরা সর্বদাই পার পেয়ে যান। দলে তাঁদের উন্নতির দরজাও বন্ধ হয় না। এঁদের অনেকেই তাই একাধিক বার মনোনয়ন পেয়ে কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত সদস্য বা আরও বড় মাপের জনপ্রতিনিধি হতে পারেন। হয়তো এ বারেও তা-ই হবে। কোনও বিধিগত কারণে নিজেরা প্রার্থী হতে না পারলে তাঁরা পরিবারের অন্য কাউকে অনায়াসে প্রার্থিপদ ‘পাইয়ে’ দিতে সক্ষম। কারণ, দলে তাঁদের মাথায় হাত রাখার মতো আরও বড় মাপের নেতার অভাব নেই। যেমন, কলকাতার এক কাউন্সিলর সম্পর্কে ইদানীং শুনতে পাচ্ছি, তিনি নাকি তাঁর ওয়ার্ড এ বার মহিলা প্রার্থীর জন্য সংরক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা জানতে পেরে তড়িঘড়ি ছেলের বিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছেন! উদ্দেশ্য স্পষ্ট।
যাঁরা ওই সব কাউন্সিলর, নেতা বা জনপ্রতিনিধিদের ‘চাপ’-এর প্রত্যক্ষ শিকার এবং বাকি যাঁরা এগুলি দেখেন বা বোঝেন, তাঁদের মনে তৃণমূল সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে সেটা ক্ষতিকর ও অসম্মানের। অথচ তাঁর দলের তকমা বহন করে ওই শ্রেণির জনপ্রতিনিধিরা সেই ক্ষতিটাই করে চলেছেন। তাঁরা ভোটে জিতলেও সেখানে যে সুস্থ জনমতের প্রতিফলন ঘটে না, সেটাও অস্বীকার করার নয়।
তৃণমূলের পরিচালন ব্যবস্থায় একটি বড় অসুবিধার দিক হল, মমতার নজর না পড়লে অনেক ফাঁকই ভরাট হয় না। সেটা আবার অনেকের জন্য ‘সুবিধা’রও বটে। কারণ ‘দিদি’র কানে নিচুতলার খবর যত ক্ষণে পৌঁছবে, তত ক্ষণে তাঁদের ‘কাজ’ গুছোনো হয়ে যাবে! তবু ফাঁকফোকর দিয়ে কোথাও কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ মমতার কানে পৌঁছলে হয়তো সাময়িক নাড়াচাড়া পড়ে। তবে তাতেও ইদানীং বহু ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান হয় না।
কলকাতার কাছে একটি পুরসভার কথা জানি। সেখানে রাজ্য সরকারের কম খরচে গৃহনির্মাণ প্রকল্পে একটি সংস্থা কয়েকশো বাড়ি তৈরির বরাত পায়। সংশ্লিষ্ট পুরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান জায়গা চিহ্নিত করার আগেই প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা ‘বখরা’ আদায় করে নেন। তাঁর নিজের দশ জন লোককে প্রকল্পে চাকরি দেওয়ার জুলুম করে তাঁদের নামে মাস-মাইনে তুলতে শুরু করেন। বিষয়টি কানে যেতে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এক বার প্রকাশ্য বৈঠকে ওই পুর প্রতিনিধিকে সতর্ক করে টাকা ফেরাতে বলেছিলেন। বছর ঘুরে গিয়েছে। ফেরত দূর অস্ত্, ওই ব্যক্তি স্বপদে দাপটে বহাল।
অন্য এক জেলায় পুরসভার এক কাউন্সিলর তো এই একই রকম প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট নির্মাণ সংস্থার কাছ থেকে আগাম কাটমানি বুঝে নিয়ে এই পর্যন্ত মাত্র চার-পাঁচটি বাড়ির জায়গা চিহ্নিত করেছেন বলে শোনা যায়। ফলে প্রকল্পটিও এগোচ্ছে না। দক্ষিণ দমদমে নাকি একটি এলাকায় প্রোমোটাররা জনৈক পুর-প্রতিনিধিকে আগাম বর্গফুট পিছু পাঁচশো থেকে সাতশো টাকা অগ্রিম নজরানা না দিলে কাজ শুরু করা কঠিন। সেখানে এমনকি কোনও প্রকল্পে দু’কোটি টাকা কাটমানি দাবির কথাও শুনেছি। সত্য-মিথ্যা জানি না।
সমস্যা এখানেও। কারণ মুখ্যমন্ত্রীর অভয়বাণীতে ভরসা করে যে ভাবে স্রোতের মতো অভিযোগ আসতে শুরু করেছে, সেগুলির সত্যাসত্য যাচাই হবে কী ভাবে? এর একটা আইনগত দিকও তো ভেবে দেখার। ধরা যাক, কেউ কাটমানি নিয়েছেন। প্রমাণ? তিনি তো রসিদ কেটে টাকা নেননি। ফলে কিছু ক্ষেত্রে এই ফাঁক গলে ঘুষখোরেরা পালানোর পথ পেয়ে যেতে পারেন। আবার যিনি ঘুষ দিয়েছেন, তিনিও তো আইনের চোখে নিরপরাধ হবেন না। সেটাও তো অপরাধ। অতএব বিষয়টি ঘোলা জলে ঢেউ তোলার চেয়ে বেশি কী হবে, সেই সংশয় থেকেই যায়।
তবে এখন যা হচ্ছে, সেটা হল এক ধরনের সামাজিক নৈরাজ্য। ঘুষের টাকা ফেরতের দাবি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা অবনতির পরিস্থিতি। দিনে দিনে এটা বাড়ছে। যার সুযোগ নিতে ওত পেতেেছ বিজেপি।
তবু মমতার ‘সদিচ্ছা’ একটু মান্যতা দাবি করতেই পারে। বলা যেতেই পারে, তিনি অন্তত চোর-কুঠুরির তালা খোলার ‘সাহসটুকু’ দেখিয়েছেন! আর কেউ তো কখনও এটাও করেননি। সিপিএমের আমলেও পঞ্চায়েতের কাজে ভুয়ো মাস্টার রোলের মাধ্যমে টাকা তোলা থেকে শুরু করে পাড়ায় পাড়ায় তোলাবাজি, মস্তানি-ট্যাক্স আদায়, কাউন্সিলর বা পার্টি অফিসকে নজরানা দেওয়া ইত্যাদি কোনও অভিযোগই বাকি ছিল না। কিন্তু একটিও শব্দ শোনা যায়নি তখন।
ভাগ্যের পরিহাস, মমতা ক্ষমতায় আসার পরেও ছবিটি বদলায়নি। হয়তো প্রক্রিয়ায় কিছু বদল ঘটেছে। তথাপি ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন এবং আগামী বছর সম্ভাব্য পুর-নির্বাচনগুলির দিকে তাকিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বর্তমান উদ্যোগ জনমনে কত দূর আস্থা ফেরাতে পারবে, এখনই বলা কঠিন। আপাতত তাঁর ‘সাহস’ই দলের ভরসা।
কিন্তু মুদ্রার অন্য পিঠও আছে। এর পরে ‘ভুবন’রাও হয়তো কামড়ানোর জন্য কান খুঁজবেন। আর কে না জানে, কান টানলে মাথা আসে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy