ছোটবেলায় স্কুলে পণ্ডিতমশাইয়ের কাছ থেকে শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল: “ধর্মার্থকামমোক্ষাণাম্ আরোগ্যং মূলমুত্তমম্। রোগস্তাপহর্তারঃ শ্রেয়সো জীবিতস্য চ।” মর্মার্থ, সুস্বাস্থ্যই সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণ, রোগ আমাদের ভাল থাকা এবং জীবিত থাকার পথে সব থেকে বড় বাধা। শুধু চরক সংহিতা-র এই শ্লোকেই নয়, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে সুস্বাস্থ্যের কামনা নিয়ে প্রচুর উল্লেখ।
প্রাচীন এই প্রজ্ঞা সমৃদ্ধতর হয়েছে বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশে। সেই বিজ্ঞান আমাদের শিখিয়েছে, কোনও দেশের বা অঞ্চলের মানুষের আয়ু, কর্মক্ষমতা এবং জীবনের মান কী হবে, তা অনেকটাই নির্ধারিত হয়ে যায় সেই দেশের নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ভিত্তিতে। মা অপুষ্ট ও স্বাস্থ্যহীন হলে তার কুপ্রভাব পড়ে সন্তানের স্বাস্থ্যের উপর। এবং, দেশের প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্য অনেকখানিই নির্ধারিত হয়ে যায় শৈশবে। মোটা দাগের এই উপলব্ধি থেকে ভারতে ১৯৯২-৯৩ সালে শুরু হয় দেশের জনসমুদয়ের, বিশেষত নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ— দেশে-বিদেশে খুবই প্রামাণ্য বিবেচিত ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে’ বা এনএফএইচএস।
সম্প্রতি প্রকাশিত হল এনএফএইচএস-এর পঞ্চম দফার আংশিক তথ্য— দেশের সতেরোটি রাজ্য ও পাঁচটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রতিবেদন। বাকি রাজ্যগুলোর তথ্যের জন্য আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। তা হলেও, যে চিত্রটা হাতে এসেছে তা থেকে দেশের নারী-শিশুদের স্বাস্থ্য বিষয়ে অনেকখানি জানতে পারা যাচ্ছে। ছবিটা এক কথায় উদ্বেগজনক। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার যে দিকটা উঠে এসেছে তা হল— শিশুদের পুষ্টির ব্যাপারে অবনতি এবং নারী ও শিশুদের রক্তাল্পতার বৃদ্ধি; এবং অনেক রাজ্যে, বিশেষত পূর্বাঞ্চলে, মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে ও গর্ভধারণের প্রবণতা। অপুষ্টির যে তিনটি প্রধান সূচক ধরা হয়েছে, সেগুলি হল: বয়সের নিরিখে উচ্চতা কম হওয়া (স্টান্টিং), উচ্চতার নিরিখে ওজন কম হওয়া (ওয়েস্টিং), এবং বয়সের নিরিখে ওজন কম হওয়া (আন্ডারওয়েট)। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক দাবি করছে যে, শিশুদের অপুষ্টির ব্যাপারে “অনেক রাজ্যে উন্নতি দেখা গিয়েছে, এবং কোনও কোনও রাজ্যে সামান্য অবনতি দেখা গিয়েছে।” কিন্তু, তথ্য বলছে, অধিকাংশ রাজ্যেই এই তিনটি সূচকে হয় অবনতি ঘটেছে, অথবা যা ছিল তা-ই আছে। অথচ, ১৯৯৮-৯৯, ২০০৪-০৫, এবং ২০১৪-১৫’র সমীক্ষায় এই সূচকগুলোতে উত্তরোত্তর উন্নতি দেখা গিয়েছিল— যদিও উন্নতির মাত্রা নিয়ে অসন্তোষ ছিল, কেন আরও দ্রুত গতিতে উন্নতি হচ্ছে না, এই প্রশ্নটা বার বার করা হচ্ছিল। এ বারের সমীক্ষা প্রশ্নটাকেই বদলে দিল: উন্নতির ধারাটা তো বজায় থাকলই না, উল্টে অবনতি কেন ঘটল, বা স্থিতাবস্থা কেন বজায় থাকল? স্থিতাবস্থাও কিন্তু অবনতি— এগোতে না পারা আসলে ব্যর্থতা।
এই প্রশ্নটা আরও বিশেষ করে ওঠে এই কারণে যে, টিকাকরণ, প্রতিষ্ঠানে প্রসব, নারীদের মধ্যে অপুষ্টির মাত্রা, এবং শিশুমৃত্যুর হারের মতো কিছু সূচকে তো উন্নতি ঘটানো গিয়েছে— তা হলে পুষ্টি, রক্তাল্পতা ইত্যাদি অতি গুরুত্বপূর্ণ সূচকে অন্তত অবনতি রোধ করাও সম্ভব হল না কেন? একটা প্রধান কারণ, ভারত সরকারের অগ্রাধিকারে বদল: গত কয়েক বছরে সাধারণ ভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে, এবং বিশেষ করে শিশুদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের উন্নতিতে, অর্থবরাদ্দ কমেছে। কিন্তু, তার সঙ্গে বিশেষ বিশেষ রাজ্যের সামাজিক-রাজনৈতিক গঠনের দিকটাও এড়িয়ে যাওয়া চলে না।
আমাদের রাজ্যের কথাই ধরা যাক। এ রাজ্য কয়েকটি সূচকে চোখে পড়ার মতো উন্নতি করেছে। যেমন নবজাতক, এক বছরের কমবয়সি, এবং পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশুর মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। বস্তুত, কেরলের মতো ঐতিহাসিক ভাবে এগিয়ে থাকা রাজ্যকে বাদ দিলে, এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের স্থান বেশ উপরের দিকে। তেমনই, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে প্রসবের ব্যাপারে প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। এক দিকে বেড়েছে সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে প্রসবের হার, অন্য দিকে কমেছে প্রসবের খরচ। আরও উল্লেখযোগ্য ভাবে ৬-২৩ মাস বয়সি শিশুদের মধ্যে পর্যাপ্ত আহার পাওয়াদের অনুপাতও অনেকটা বেড়ে কেরলের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। এই সূচকগুলি এবং অন্য বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী, এ-রাজ্যে সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্যব্যবস্থাতে কিছুটা হলেও সংস্কার ঘটানো সম্ভব হয়েছে। অথচ, এখনও এক-তৃতীয়াংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম, এবং প্রায় সম-অনুপাতের শিশুর বয়সের তুলনায় ওজন কম। এরই পাশাপাশি উঠে আসছে কম বয়সে বিয়ে হওয়া এবং গর্ভধারণের এক ভয়াবহ ছবি। যে পশ্চিমবঙ্গ কিছু সূচকে বহু রাজ্যের তুলনায় রীতিমতো উৎকর্ষের প্রমাণ দিয়েছে, সেই রাজ্যই আবার নাবালিকা-বিবাহের ব্যাপারে ভয়াবহ অবস্থায়। পারিবারিক ও যৌন হিংসার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
নারী ও শিশু স্বাস্থ্যের সূচকগুলিতে রাজ্যভেদে অনেক তারতম্য থেকে যাচ্ছে। আবার রাজ্যগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন জেলার মধ্যে পার্থক্য থেকে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গেই যেমন: ভাল ও খারাপ, উভয় সূচকের মধ্যেই জেলাওয়াড়ি তারতম্য বিস্তর। যেমন, সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে প্রসবের হার বাঁকুড়াতে ৮৩ শতাংশ, অথচ নদিয়াতে ৫৪ শতাংশ; গর্ভাবস্থায় অন্তত চার বার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করানোর অনুপাত হাওড়াতে ৮৯ শতাংশ, কিন্তু পুরুলিয়াতে ৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ, শিশু ও নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যে রকম পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম হাতে নেওয়া দরকার, সে ব্যাপারে কোথাও বড় রকমের খামতি থেকে যাচ্ছে।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ঘোরতর সামাজিক সমস্যা। যেমন, নাবালিকা-বিবাহ। এনএফএইচএস দেখাচ্ছে, এ রাজ্যে ৪২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে (আগের সমীক্ষাতেও ছবিটা তা-ই ছিল)। তথ্যটা জনগণনার মতো অন্যান্য সূত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এই অনুপাতে যদি বাল্যবিবাহ হয়, এবং ফলস্বরূপ অপরিণত মাতৃত্বের অনুপাতও বেশি থাকে (এ রাজ্যে ১৬%), তা হলে অন্যান্য দিকে যত উন্নতিই ঘটানো যাক না কেন, পুষ্টির সূচকে উন্নতি করা কঠিন।
এক সংখ্যা দিয়ে আর এক সংখ্যাকে ঢাকা দেওয়া যায়, সমস্যাটাকে আড়াল করা যায়, কিন্তু সমাধান পাওয়া যায় না। প্রয়োজন দুরবস্থাগুলোর কারণ এবং প্রতিকার বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান এবং বহুমুখী কর্মপ্রক্রিয়া। একটা উদাহরণ দেখলে বক্তব্যটা খোলসা হতে পারে: সরকারি প্রকল্পগুলো সাধারণত একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গৃহীত হয়, মাথাপিছু হিসেব কষে জেলা বা প্রাসঙ্গিক স্তরে অর্থবরাদ্দ এবং কর্মপদ্ধতি ঠিক করে দেওয়া। কিন্তু, সমস্যাগুলোর ভিন্ন ভিন্ন উৎস থাকে; এদের মধ্যে এমন কিছু ব্যাপার থাকে, যা সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। যেমন নাবালিকা বিবাহ। সাধারণ ধারণা হচ্ছে, নাবালিকা বিবাহের কারণ অশিক্ষা, বা সামাজিক-আর্থিক উন্নয়নের অভাব। আবার অনেকে এই প্রবণতাকে ধর্ম ও জাতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে ভালবাসেন। কিন্তু তথ্য বলছে, নাবালিকা-বিবাহের নিরিখে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হিন্দু-প্রধান পূর্ব মেদিনীপুরের (৫৮%), যে জেলাটি সাক্ষরতার হারে পশ্চিমবঙ্গের সেরা। এর পরের স্থান মুসলমান-প্রধান মুর্শিদাবাদের (৫৫%)। আদিবাসী ও দলিত-প্রধান জলপাইগুড়িতে এই হার খুব কম (১৮%)।
অসুখটা কঠিন, এবং জটিল— যা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান হিংসা, বিদ্বেষ, ও পশ্চাদ্গতির সঙ্গেও যুক্ত। কিন্তু, এ রাজ্য থেকেই পাওয়া কিছু প্রমাণ বলছে, উদ্যোগ করলে তা সারিয়ে তোলা কঠিন নয়। পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে শিখেছিলাম, “ন নামমাত্রেণ করোত্যরোগম্”— ঔষধের নাম নিয়ে ‘রোগী আরোগ্য হোক’ বললেই সে সুস্থ হয়ে ওঠে না। রোগ দূর করতে হলে ঠিকঠাক এবং নিয়মিত ঔষধ প্রয়োগ করতে হয়। তার আগে অবশ্য রোগটা যে দেশের, এবং দেশটা যে দেশবাসীর— নেতা বা আমলাদের নয়— সেই স্বীকৃতিটা জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy