যে সমস্ত মহান শিক্ষক যুগ যুগ ধরে অজ্ঞানতার অন্ধকার পরিবেশ থেকে জ্ঞানের আলোকে আমাদের উন্নীত করে আসছেন, সেই প্রাচীন কালের আর্যভট্ট, চড়ক থেকে শুরু করে হাল আমলের শ্রদ্ধেয় এ পি জে আব্দুল কালাম— তাঁদের সবার প্রতি শিক্ষক দিবসে আমরা শ্রদ্ধা ও সম্মান জ্ঞাপন করি। কিন্তু আমাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষক দিবসে অবশ্যই আরেক জনকে স্মরণ করতে হবে। যিনি মাত্র পাঁচ বছর শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। এবং এক জন ভারতীয় না হয়েও ভারত তথা বাঙালির চিন্তাচেতনার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সমর্থ হয়েছিলেন।
সেই মহান শিক্ষকের নাম লুই ভিভিয়ান ডিরোজিয়ো। ঔপনিবেশিক যুগে, বিশেষ করে উনিশ শতকে যখন কিছু সম্পন্ন বাঙালি মধ্যযুগীয় টোল, মাদ্রাসার প্রথাগত শিক্ষা থেকে মূলত কর্ম ও অর্থ উপার্জনের জন্য পাশ্চাত্য রীতির শিক্ষা নিতে শুরু করেন, সেই সময়ে যে গুটিকয়েক শিক্ষকের আবির্ভাব হয়েছিল তার মধ্যে ডিরোজিয়ো ছিলেন সর্বোত্তম। যিনি ছাত্রদের মধ্যে রক্ষণশীলতার গণ্ডি অতিক্রম করিয়ে মুক্তচিন্তার পথের সন্ধান দিতে পেরেছিলেন। বাঙালিকে ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ হতে সাহায্য করেছিলেন। সমাজের কূপমণ্ডকতাকে কষাঘাত করে নবজীবনের, নবজাগরণের আলোর পথ দেখাতে পেরেছিলেন তিনি। হিন্দু কলেজের অল্প সময়ের শিক্ষকতা কালে তিনি ছাত্রসমাজে এতই জনপ্রিয় হন যে, শিবনাথ শাস্ত্রী উক্তি করেন— ‘‘চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে তেমনই তিনিও অপরাপর শ্রেণির বালকদিগকে আকৃষ্ট করিলেন।’’
উনিশ শতকের ক্ষণজন্মা কিন্তু অল্প সময়ে অমরকীর্তি গড়ে যাওয়া শিক্ষক ডিরোজিয়ো, যাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বাঙালি অবগত না হলে শিক্ষক দিবসের তাৎপর্য অনেকটা ম্লান হয়ে যায়। যাঁর অনন্যসাধারণ চিন্তা, বাগ্মিতা, যুক্তি, মননশীলতা, বিচার-বিশ্লেষণ, ছাত্রদের বন্ধু রূপে আপন করে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে মানসিক দূরত্ব কমিয়ে নতুন যুগের চিন্তাধারা তৈরিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ব্রিটিশদের আগমনে পূর্বে এ দেশীয় মানুষের টোল-মাদ্রাসায় ন্যায়, নব্যন্যায়,অর্থশাস্ত্র, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা নিতেন। এর পর যখন আঠারো শতকের শেষ প্রান্তে কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হল, তখন কিছু সংখ্যক এ দেশীয় মানুষ অর্থ রোজগারের প্রয়োজনে ব্রিটিশদের সঙ্গে কাজ করার কথা ভাবেন। তাঁদের মনে হল— ইংরেজি শিখতে হবে। সেই সময়ে অবশ্য ইংরেজি শিক্ষা বলতে বোঝানো হত ইংরেজি শব্দ শিক্ষা। দেশীয় লোকেরা ইংরেজি শিখতে লাগলেন সাহেবদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করবেন বলে। এবং যে যত বেশি ইংরেজি শব্দ শিখতে পারতেন, তখনকার সমাজে তিনি তত বড় পণ্ডিত বলে স্বীকৃত হতেন।
এর পর দেশীয় ইংরেজি শব্দ-শিক্ষা পাওয়া মানুষেরা যখন সাহেবদের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে ভাববিনিময় করে প্রচুর অর্থের মুখ দেখতে লাগলেন, তাঁদের দেখে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ ইংরেজি শেখার তাগিদ অনুভব করে। তার ফলে কিছু সংখ্যক বেনিয়া ব্রিটিশ ও ফিরিঙ্গিরা ব্যক্তিগত ব্যবসার ক্ষেত্র হিসাবে নিজেদের উদ্যোগে ছোট ছোট ইংরেজি শিক্ষার স্কুল খুলতে থাকে। সেই আমলে ব্রিটিশ ও ফিরিঙ্গিদের স্থাপন করা স্কুলগুলির মধ্যে যে স্কুলগুলি উল্লেখযোগ্য ছিল, সেগুলি হল— উত্তর চিৎপুর অঞ্চলে আদি ব্রাহ্মসমাজের কাছে অবস্থিত শেরবোর্ন স্কুল, বৈঠকখানার হাটম্যানের স্কুল আর ধর্মতলার ড্রামন্ডের স্কুল। এ ছাড়াও আমড়া তলায় মার্টিন বাউলের স্কুল, আমহার্ট স্ট্রিটের পূর্ব দিকে মেকলের স্কুল। এ ছাড়া আরও অনেক স্কুল। এই সকল স্কুলে পাঠ নেওয়া বিখ্যাত ব্যক্তিরা হলেন মতিলাল শীল (বাউলের স্কুল), দ্বারকানাথ ঠাকুর (শেরবোর্ন স্কুল)।
ডিরোজিয়ো শৈশবের শিক্ষা নেন ড্রামন্ডের স্কুলে। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে এক পর্তুগিজ ফিরিঙ্গি পরিবারে ডিরোজিয়ো জন্ম নেন। ধর্মতলার মৌলালির দরগার কয়েক গজ দক্ষিণের এক বাড়িতে।
বিনয় ঘোষ ডিরোজিয়ো-র পরিবার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘কলকাতা শহরে পর্তুগিজ সমাজে ডি’রোজারিয়োর পরিবারের বেশ প্রতিষ্ঠা ছিল মনে হয়। ডিরোজিয়োর পিতা ‘জে স্কট অ্যান্ড কোং’ নামে কলকাতায় এক বিখ্যাত সদাগরী হৌসে উচ্চপদস্থ চাকুরে ছিলেন। তিনি সম্পন্ন মধ্যবিত্ত ছিলেন, কারণ কলকাতার গৃহসম্পত্তি তিনি নিজের অর্থেই করেছিলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে পাননি। পর্তুগিজরা তখন এ দেশে ফিরিঙ্গি সমাজে সংখ্যালঘু হলেও বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিপত্তির দিক দিয়ে অনেক গণমান্য ছিলেন। ডি’রোজারিয়োর পরিবার তাঁদের অন্যতম।’’
ডিরোজিয়োর পরিবার আর্থিক প্রতিপত্তি থাকার জন্য ডিরোজিয়োকে তাঁর পরিবার সে সময়ের কলকাতার সব চেয়ে বিখ্যাত স্কুল ড্রামন্ডের ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে বিদ্যা শিক্ষার জন্য ভর্তি করিয়ে দেয়।
যে স্কুলের খবর সেই সময়কার ‘ক্যালকাটা গেজেট’, ‘সমাচার দর্পণ’ প্রভৃতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত। সেই সংবাদ থেকে ডিরোজিওর ছাত্রবস্থার যে খবর জানা যায়, সেখানে আমরা দেখি— তিনি মাত্র আট বছর বয়সে আবৃত্তি, ভূগোল ও অন্য বিষয়ে মেধা প্রদর্শনের জন্য একটি স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। সেই ধারা অব্যাহত রেখে তার পরের বছরে সেই একই কৃতিত্বের জন্য স্কুল থেকে পুরস্কার পান।
ডিসেম্বর মাস, ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ‘ইন্ডিয়া গেজেট’এর সম্পাদক ধর্মতলা অ্যাকাডেমির বাৎসরিক পরীক্ষার ফলপ্রকাশের যে খবর ছেপেছিলেন, তাতে লেখা ছিল— ‘‘....ডিরোজিয়ো নামে এক ছাত্র শেক্সপীয়রের শাইলক চরিত্রের এমন অপূর্ব চিত্র তার আবৃতির বাচন ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছিলো যা ওই বয়েসের স্কুলের ছাত্রের পক্ষে অভাবনীয় বলা চলে। কলম্যানের একটি হাস্যকৌতুকের কবিতাও সে আবৃতি করেছিলো চমৎকার হাস্যদ্দীপক ভঙ্গীতে।’’
শিক্ষা শেষের পর ডিরোজিয়ো মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে কর্মে নিযুক্ত হন। সদাগরি অফিসে কেরানির চাকরি। কিন্তু বেশি দিন কেরানিগিরিতে মন টিকল না ডিরোজিয়োর। চাকরি ছেড়ে চলে এলেন ভাগলপুরের মাসির বাড়িতে।
উদ্ধৃতির ভিতরে বানান অপরিবর্তিত
শান্তিপুর হরিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy