Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
India

বিপন্ন

রিয়া চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে সিবিআই, ইডি, এনসিবি যে অভিযোগগুলি খাড়া করিয়াছিল, তাহার সব কয়টিই এখনও অবধি অপ্রমাণিত। কিন্তু, তাঁহাকে অপরাধী সাব্যস্ত করিতে সমাজ সেই বিচারের অপেক্ষা করে নাই।

ভারভারা রাও এবং সোমা সেন। ফাইল চিত্র।

ভারভারা রাও এবং সোমা সেন। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২০ ০০:১০
Share: Save:

শাসক যদি ক্রমে একনায়কতন্ত্রী হইয়া উঠিতে চাহে, সাধারণ মানুষ তবে কাহার নিকট ত্রাণ প্রার্থনা করিবেন? এত দিন এই প্রশ্নের উত্তরটি ভারতের মানুষ অভ্রান্ত জানিতেন: তাঁহাদের রক্ষাকবচটির নাম গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। বিশেষত আদালত। ইন্দিরা গাঁধীর আমলের ‘কমিটেড জুডিশিয়ারি’ নামক কলঙ্কটি মুছিয়া পরবর্তী চার দশকে ভারতের বিচারব্যবস্থা বহুলাংশে নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারের অতন্দ্র প্রহরী হইয়াছিল। সেই ভরসায় যদি ফের ধাক্কা লাগে, তাহা দুর্ভাগ্যজনক হইবে। সম্প্রতি কিছু মামলায় অভিযুক্তকে জামিন না দেওয়ার প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠিতেছে। মুম্বইয়ে বিশেষ আদালত ফের কবি ভারাভারা রাও ও অধ্যাপিকা সোমা সেনের জামিন না-মঞ্জুর করিল। অশীতিপর কবি বা ষাটোর্ধ্ব অধ্যাপিকার প্রকট শারীরিক অসুস্থতাও তাঁহাদের জামিনের ব্যবস্থা করিতে পারিল না। অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তীকে এক অতি সামান্য অভিযোগেও এক মাস হাজতবাস করিতে হইল। বাস্তবিক, ভারাভারা রাও দেশের শাসকদের মিত্র নহেন— তাঁহার উপর রাজরোষ আছে। অন্য দিকে, রিয়া চক্রবর্তীর ভাগ্যও রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে জড়াইয়া গিয়াছে— সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুকে বিহারের নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রশ্ন করিয়া তুলিবার যে প্রকল্প বিজেপি লইয়াছিল, তাহাতে রিয়াকে যূপকাষ্ঠে দাঁড় না করাইলে চলিতেছিল না। ভিন্ন কারণে হইলেও, যাঁহাদের প্রতি রাষ্ট্র খড়্গহস্ত, তাঁহাদের জামিন নামঞ্জুর হইল। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা লইয়া দুর্ভাবনা অকারণ নহে।

রিয়া চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে সিবিআই, ইডি, এনসিবি যে অভিযোগগুলি খাড়া করিয়াছিল, তাহার সব কয়টিই এখনও অবধি অপ্রমাণিত। কিন্তু, তাঁহাকে অপরাধী সাব্যস্ত করিতে সমাজ সেই বিচারের অপেক্ষা করে নাই। সংবাদমাধ্যমের একাংশ প্রাত্যহিক সান্ধ্য তরজায় খাপ পঞ্চায়েত বসাইয়াছে। কেহ বলিতে পারেন, সমাজ যাহা দেখিতে চায়, টেলিভিশনের অনুষ্ঠান তাহাই দেখাইয়াছে— ইহাই বাজারের নিয়ম। সন্দেহ করিবার বিলক্ষণ কারণ আছে, প্রক্রিয়াটি বিপরীতমুখী— সংবাদমাধ্যমের একাংশ, শাসক দলের স্বার্থরক্ষার উদগ্র তাগিদে, নৈতিকতার বালাইকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়া সামাজিক কুনাট্যের সুর বাঁধিয়া দিয়াছে। প্রবণতাটি অতি বিপজ্জনক। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব বিপুল। সরকারের স্বার্থরক্ষা করা, তাহার সুরে সুর মিলানো, সরকারের ব্যর্থতাকে ঢাকিয়া অবান্তর প্রশ্ন লইয়া মাতিয়া থাকা সংবাদমাধ্যমের কাজ নহে। জনজীবনে নিজেদের প্রভাব ব্যবহার করিয়া সংবাদমাধ্যম প্রকৃত প্রশ্নগুলিকে গুলাইয়া দিতে চাহিলে, তাহা গণতন্ত্রের পক্ষে মর্মান্তিক দুঃসংবাদ।

টিআরপি সংক্রান্ত বিতর্কে স্পষ্ট, পচন কতখানি গভীরে। কোনও একটি বা একাধিক সংবাদ চ্যানেল টিআরপি-র হিসাবে কারচুপি করিয়া নিজেদের অগ্রগণ্য সংবাদমাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিতে চাহে, এবং সেই সূত্রেই অন্য চ্যানেলগুলির প্রভাব খাটো করিয়া দেখাইতে চাহে, ইহা এই কেলেঙ্কারির একটি দিক মাত্র। বিপরীত প্রান্তে আছে সরকার। টিআরপি-র সুতায় টান দিয়া সরকারও সংবাদমাধ্যমগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করিতে চাহে। একনায়কতন্ত্রের ইহাই দস্তুর— গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির জোর নষ্ট করিয়া দেওয়া, যাহাতে শাসকদের অন্যায়ের প্রতিরোধ দূরে থাকুক, প্রতিবাদটুকু করিবার পরিসরও আর না থাকে। শাসনবিভাগ এমনিতেই সরকারের আজ্ঞবহ— তাহার মেরুদণ্ডের জোর আরও কমিতেছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলি এত দিন অবধি কম-বেশি স্বাধীন থাকিয়াছিল, এখন সেগুলিকেও দখল করিবার সর্বাত্মক প্রয়াস চলিতেছে। সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম সাক্ষ্য দিবে, গভীরতর বিপন্নতার সম্মুখীন হইতেছে ভারতীয় গণতন্ত্র।

অন্য বিষয়গুলি:

India Democracy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy