দিল্লির রাজনীতিতে আরও প্রাসঙ্গিক। বুধবার সমাবেশ মঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। ছবি: পিটিআই।
বছর সাতেক আগের একটা সময়ের কথা মনে করিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে দিনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন দিল্লিতে, কিন্তু শেষ হাসিটা হাসতে পারেননি। আজ ফের দিল্লির রাজনীতিতে তিনি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন, এবং এ বার মুখমণ্ডলে বেশ চওড়া হাসি নিয়ে ফিরলেন।
২০১২ সাল, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে প্রবল তৎপরতা দিল্লিতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায়। দেশের তদানীন্তন শাসক জোট অর্থাৎ কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সিদ্ধান্ত নিয়েছে— প্রণব মুখোপাধ্যায়কে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করা হবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানছেন না কিছুতেই। তিনি এ পি জে আবদুল কালামের নাম প্রস্তাব করছেন, মনমোহন সিংহের নাম প্রস্তাব করছেন, কিন্তু প্রণবকে মানতে রাজি নন। বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে দিয়েছিলেন মমতা। মুলায়ম সিংহ যাদবের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করেছিলেন। সে বৈঠকে মমতাকে এক রকম আশ্বাস দিয়েছিলেন মুলায়ম আর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর এক রকম। বেশ অপ্রস্তুতেই সে দিন পড়তে হয়েছিল বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবার দিল্লিতে অত্যন্ত সক্রিয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এ বার আর অপ্রস্তুত নয়, অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন জাতীয় রাজনীতির আঙিনায় তিনি।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
মোদী বিরোধী রাজনীতির পরিসরে গত কয়েক বছর ধরে ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত কয়েক মাসে সে ভূমিকা আরও স্পষ্ট হয়েছে। দিল্লিতে বুধবার বিরোধী শিবিরের যে যৌথ সমাবেশ হল, সে সমাবেশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা দিয়ে দিল মোদী বিরোধী ব্রিগেডের অগ্রগণ্য কম্যান্ডার হিসেবে। জাতীয় রাজনীতির দীর্ঘ দিনের রথী-মহারথীরা যন্তরমন্তরের সমাবেশ থেকে প্রায় একযোগে স্বীকার করলেন— বিজেপি বিরোধী সংঘর্ষে গোটা দেশকে পথ দেখাচ্ছেন মমতা।
আরও পড়ুন: তুমুল হর্ষধ্বনি, বলিউডি গানের প্যারোডি, মমতা সমাবেশে পৌঁছতেই উৎসবের মেজাজ কেজরীবালের মঞ্চে
বিজেপির পথ ঠিক, নাকি বিরোধীদের পথ— সে নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু যে শিবিরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রয়েছেন, সেই শিবিরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো পথটাই যে ঠিক— তা নিয়ে আর কোথাও কোনও সংশয় রইল না।
নরেন্দ্র মোদীর সরকারের নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সরব হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধী শিবিরের যে কোনও যৌথ কর্মসূচিতে তাঁর মতামত বরাবরই গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু ১৯ জানুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সুবিশাল সমাবেশ করে তিনি জাতীয় রাজনীতির আলো যতখানি ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন নিজের দিকে, ততটা আগে আর কখনও পারেননি। বুধবার দিল্লির যন্তরমন্তর রোডের সমাবেশটা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে রইল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য। এ সভার আয়োজক তিনি নিজে ছিলেন না। তাই বাধ্যবাধকতা থেকে তাঁকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন অন্য বিরোধী দলগুলির ছিল না। তবু গোটা দেশ থেকে হাজির হওয়া প্রবীণ রাজনীতিকরা অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে এ দিন উচ্চারণ করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। বিজেপির বিরুদ্ধে বৃহত্তর জোট গড়ার প্রয়াসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যন্তরমন্তরের সমাবেশে তা স্বীকার করে গেলেন প্রায় প্রত্যেকে।
আরও পড়ুন: বেজায় অসন্তুষ্ট মমতা, যন্তরমন্তরের মঞ্চ থেকে কঠিন বার্তা কংগ্রেসকে
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই দিল্লি সফর কি পুরোটাই কুসুমাস্তীর্ণ? কাঁটা কি একটাও নেই? কাঁটা রইল। সংসদের অধিবেশনের শেষ দিনে দুর্নীতির প্রশ্নে তৃণমূলের দিকে আঙুল তুলে কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীর ভাষণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অস্বস্তি নিশ্চয়ই বাড়িয়েছে। বাংলার রাজনীতিতে কংগ্রেস, বাম এবং বিজেপি যে একযোগে তাঁর বিরোধিতা করছে— সমাবেশ মঞ্চে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই তা স্বীকার করেছেন। কিন্তু বাংলায় পরিস্থিতি যা-ই হোক— জাতীয় রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব মেনে নেওয়া যে অনেকগুলো আঞ্চলিক দলের কাছেই এখন অবশ্য পালনীয় কর্তব্য, তা বিরোধী শিবিরের নেতৃবর্গের ভাষণেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। জাতীয় রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সন্তুষ্ট রাখা যে কংগ্রেসের মতো দলের জন্যও অবশ্য পালনীয় কর্তব্য এখন, সংসদের সেন্ট্রাল হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সনিয়া গাঁধীর কথোপকথনে সে ইঙ্গিতও মিলেছে।
নির্বাচন আসন্ন। তার আগে রণকৌশল সাজাচ্ছে সব শিবির। ফলাফল কী হবে, তার উত্তর সময়ই দেবে। কিন্তু এ বারের নির্বাচনী মরসুমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে গোটা দেশে অত্যন্ত আলোচিত নাম হয়ে উঠতে চলেছেন, তা নিয়ে আর কোনও সংশয় নেই।
আরও পড়ুন: মনে রাখব আমরা, ক্ষোভ সামলাতে না পেরে সনিয়াকে বললেন মমতা
দিল্লি সফরের সবটা মসৃণ হয়তো হল না। সিপিএমের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্ঘাত অনেকগুলো দশকের। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজেপির কাছেও প্রবল প্রতিপক্ষ তিনি। সেই সমীকরণেই কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব কমা উচিত ছিল, কিন্তু কমল না। এ বারের দিল্লি সফরে তা সম্ভবত বেড়েই গেল খানিকটা। যন্তরমন্তরের সমাবেশ মঞ্চে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বার্তা দিলেন, তা যেন বিজেপি এবং কংগ্রেসের সঙ্গে প্রায় সমদূরত্ব বজায় রাখারই বার্তা। চ্যালেঞ্জ নেওয়ার রাজনীতিতে যতটা অগ্রসর ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাতে এই সমদূরত্বের বার্তা দেওয়াটা একটু ঝুঁকিরই। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা-ই বলুন, কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব তাঁকে দূরে ঠেলার অবস্থায় এখন নেই। তৃণমূল চেয়ারপার্সনের সাফল্য সেখানেই।
বুধবার রাতে প্রশান্তি নিয়েই ঘুমোতে যেতে পেরেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy