দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী যদি ঘোষণা করিয়া দেন যে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেই ‘‘ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষিত হইয়াছে’’, তাঁহার বক্তব্যকে উড়াইয়া দিবার কথা ছিল না। অথচ পুলিশ শত চেষ্টাতেও যে ক্যাম্পাসে ভারত-বিদ্বেষীদের খোঁজ পায় নাই, আদালত যে পরিসরে দেশদ্রোহিতার অভিযোগকে মান্যতা দেয় নাই, মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সেখানে যুদ্ধ ঘোষণার প্রমাণ পাইলেন কোথায়? উত্তরটি তিনিও জানেন— রাজনীতিতে। জেএনইউ নামক প্রতিষ্ঠান, এবং তাহার অভ্যন্তরের উদারবাদী চিন্তার পরিসরই সীতারামনদের রাজনীতির শত্রু। সেই পরিসরটিকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে জয় করা তাঁহাদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনেও সঙ্ঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-কে পরাভূত করিয়াছে জেএনইউ। প্রভূত হিংসা, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানের চেষ্টা, এমনকি ছাত্র সংসদের সদ্যনির্বাচিত সভাপতির উপর হামলা, কিছুতেই জেএনইউ-কে দমন করা যায় নাই। তাই, নির্বাচনে আরও এক বার ধাক্কা খাইয়া আরও এক বার ক্যাম্পাস দখলের চেষ্টায় নামিতেছেন নির্মলারা। আরও এক বার হাতে তুলিয়া লইয়াছেন চেনা অস্ত্র। ভারতের বিপরীতে দাঁড় করাইয়া দিয়াছেন জেএনইউ-কে।
তথ্যপ্রমাণ ব্যতিরেকেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী সর্বসমক্ষে এ হেন গুরুতর অভিযোগ করেন কী ভাবে, নরেন্দ্র মোদীর জমানায় সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় কাহারও নাই। উদারবাদীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ খাড়া করিবার রাজনীতি পুরাতন হইলেও মোদী সরকার তাহাকে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন তলে লইয়া গিয়াছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যন্ত নিজের পদমর্যাদা ভুলিয়া সেই খেলায় নামিয়াছেন। খেলার আসরে মন্ত্রী নামিয়াছেন বলিয়াই একটি জরুরি প্রশ্ন তোলা দরকার। যে খেলায় বারে বারে মুখ পুড়িয়াছে, তাহা আবারও খেলিবার প্রয়োজন কী? নির্বাচনের ময়দানেই হউক, গায়ের জোরেই হউক বা রাষ্ট্রীয় জুজু দেখাইয়াই হউক, কোনও মতেই যখন জেএনইউ-এর হাওয়ায় ভগওয়া ধ্বজ উড়িতেছে না, প্রতিষ্ঠানটিকে ছাড়িয়া দিলে হয় না? ক্যাম্পাসে সামরিক ট্যাঙ্ক বসাইয়া দেশাত্মবোধ জাগাইবার চেষ্টা হইতে বহিরাগত বাহুবলীদের সাহায্যে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’দের শায়েস্তার কসরত, কোনওটিই তো সরকার বা সঙ্ঘ পরিবার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সম্মান বাড়ায় নাই। এবিভিপি যে ভঙ্গিতে জেএনইউ-এর ছাত্ররাজনীতির শীলিত, গণতান্ত্রিক ভঙ্গিটিকে বদলাইয়া দিল, গাজোয়ারির রাজনীতি আমদানি করিল, তাহাও দেশবিদেশে নিন্দাই কুড়াইয়াছে। আবারও তবে জেএনইউ-এর ভারতবিরোধিতার অপবাদ কেন?
এই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরগুলির মধ্যে একটি হ্রস্ব, আর একটি, তুলনায় দীর্ঘ। প্রথমটি হইল, জেএনইউ ভারতের উদারবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতীক। সেই দুর্গের পতন হইলে তাহার প্রতীকী গুরুত্ব অসীম। দ্বিতীয়ত, কোনও একটি পরিসরকে ছাড়িয়া দেওয়ার শিক্ষা নাগপুরের পাঠ্যক্রমে নাই। ‘টোটালিটারিয়ান’ স্বৈরবাদী রাজনীতির দস্তুরই হইল সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের উপর, প্রতিটি পরিসরের উপর আধিপত্য কায়েম করা। যে পরিসর বিরুদ্ধ স্বরকে আশ্রয় দেয়, লালনপালন করে, তাহাকে দমন করিতে না পারিলে ধ্বংস করাই এই শাসনতন্ত্রের লক্ষ্য। ফলে, জেএনইউ-কে তাহার মতো ছাড়িয়া দেওয়া নাগপুরের পক্ষে অসম্ভব। নির্মলা সীতারামন স্পষ্ট করিয়া দিয়াছেন, নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশে, বা তৎপরবর্তী হিংস্রতাতেই তাঁহাদের চেষ্টা শেষ হয় নাই। জেএনইউ-কে দখলের চেষ্টা অব্যাহত থাকিবে। অর্থাৎ ছাত্রদেরও কাজ ফুরাইল না। উদারবাদের ঘাঁটি আগলাইতে আরও অনেক পথ তাঁহাদের হাঁটিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy