মধ্যপ্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপকের পদে নিয়োগ হয় সম্প্রতি। আসনটি ছিল অসংরক্ষিত (জেনারেল ক্যাটেগরি)। নির্বাচিত হন অন্যান্য পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর (ওবিসি) এক মহিলা। এমন ঘটনা সে রাজ্যে এই প্রথম। মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট সেই নির্বাচকদের প্যানেল ও তাঁদের সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেয়। এই রায়ে স্থগিতাদেশ জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট। এই মামলা যে উঠল, তাতেই বোঝা যায় যে সমাজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চায়, দলিত ও আদিবাসী জেনারেল ক্যাটেগরির যোগ্য নয়।
খবরটা থেকে নজর সরিয়ে নিতে না পারার ব্যক্তিগত কারণও আছে। এক সময় কলকাতা-সংলগ্ন জেলার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংরক্ষিত আসনে আমি প্রথম নির্বাচিত হই। এত দিন এই শুনেই বড় হয়েছিলাম যে সংরক্ষিত আসনে যাঁরা চাকরি পান তাঁরা মেধার বিচারে অনেক পিছিয়ে। তাঁদের কর্মকুশলতার অভাবের জন্যই বিভিন্ন পেশায় দক্ষতা কমছে। তা হলে তো ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের উচিত ছিল তারই নির্ধারিত মেধার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হওয়া এই অধমের নির্বাচনে খুশি হওয়া। বাস্তবে ঘটল তার উল্টোটাই। মেধা তালিকায় যিনি দ্বিতীয় হয়েছিলেন, তিনি ঘটনাচক্রে ব্রাহ্মণ। তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন সেখানকার এক ব্রাহ্মণ অধ্যাপক নাকি বলেছিলেন, সংরক্ষিত আসনে আমার নির্বাচন মানা গেলেও, জেনারেল ক্যাটেগরিতে সেটা কল্পনাতীত। আমি যে হেতু তাঁর ছাত্রী ছিলাম না, তাই আমাকে অযোগ্য বলে নস্যাৎ করার একমাত্র কারণ নিশ্চয়ই আমার জাতিভিত্তিক পদবি! অসংরক্ষিত আসনে ‘এসটি’-কে মানসিক ভাবে গ্রহণ না করতে পারার জন্য আমি যত দিন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলাম, তত দিন ওই ব্রাহ্মণ অধ্যাপক অভ্যাগত (এক্সটার্নাল) সদস্য হিসেবে কোনও মিটিং-এ আসেননি। পরে জেনেছি এই অধম আদিবাসী বিদায় হওয়ার পর ওঁর যাতায়াত ছিল অবাধ।
আসা যাক সংরক্ষণের গোড়ার কথায়। সংবিধানের ১৫ এবং ১৬ নম্বর ধারা মোতাবেক তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং ওবিসি অন্তর্ভুক্ত মানুষদের জন্য শিক্ষা, সরকারি চাকরি ও আইনসভায় আসন সংরক্ষিত হয়েছে। বংশানুক্রমিক ভাবে নিপীড়নের শিকার এই সব অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মানুষরা। এঁদের প্রাপ্য সামাজিক ন্যায় ও মর্যাদা নিশ্চিত করার প্রয়াস এই সংরক্ষণ নীতি। ভারতে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মানুষ সত্তর শতাংশ হলেও, তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং ওবিসি-দের জন্য মোট ৪৯.৫% সংরক্ষিত আসন বেঁধে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট (১৯৯২)। তবে ২০০৪ সালে একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, যে কোনও অনগ্রসর সম্প্রদায়ভুক্ত মেধাবী প্রার্থী চলে আসতে পারেন অসংরক্ষিত (জেনারেল ক্যাটেগরি বা ‘ওপেন কম্পিটিশন’) আসনে। অর্থাৎ অসংরক্ষিত আসন তফসিলি জাতি, জনজাতি বা ওবিসি-র জন্য নিষিদ্ধ, এমন নয়।
প্রচুর উচ্চবর্ণের প্রগতিশীল মানুষকে বলতে শুনেছি যে তাঁরা জাতপাতের ধার ধারেন না, আর পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের জন্য তাঁরা দায়ী নন, তাই সংরক্ষণ ব্যবস্থাটা তুলে দেওয়াই শ্রেয়। এর ফলে নাকি উচ্চবর্ণের গরিব মেধাবী ছাত্ররা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তাঁরাই দেখলাম ২০১৯ সালে অসচ্ছল উচ্চবর্ণের জন্য দশ শতাংশ সংরক্ষণের সপক্ষে যুক্তি দর্শাতে দশ হাত এগিয়ে।
প্রগতিশীলতার আস্তরণে এ সব জাতক্রোধ সযত্নে লালিত ও শাণিত হয়। ‘অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন’ বা বর্ণভিত্তিক বৈষম্য কমানোর উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ প্রভৃতি উদ্যোগ, বর্ণভেদ-বিলাসীদের বৈরিতা দূর করতে পারেনি। সেই জন্যই সংরক্ষণ ব্যবস্থা অনগ্রসর সম্প্রদায়গুলির ক্ষমতায়নের স্বার্থে আজও অপরিহার্য।
যাঁরা সংরক্ষণ-বিরোধী মেধাতত্ত্ব খাড়া করেন তাঁদের সবিনয়ে মেধার সংজ্ঞা জানাই। আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুঁজি, এবং জাতিগত অন্যায় সুবিধার পুঞ্জীভূত ফল হল মেধা। এটি উচ্চবর্ণের শিক্ষিত বাবুদের বংশানুক্রমিক বা জন্মগত দক্ষতা নয়। বিশেষ কিছু সুবিধা পাওয়ার ফলেই মেধাবী মানুষ ‘তৈরি’ হয়। যেমন সন্তানকে পড়াবার সঙ্গতি, বাড়িতে পাঠলাভের পরিবেশ, এলাকায় পড়াশোনার সুব্যবস্থা, দু’বেলা সুষম আহার, সমানুভূতিশীল শিক্ষক ও সহপাঠী, সুযোগ সুবিধা বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকা এবং সেগুলোর সদ্ব্যবহার, সঠিক পরামর্শদাতা ও পৃষ্ঠপোষকের সঙ্গে যোগাযোগ। যে দিন চড়া দামে প্রাইভেট টিউশন আর কোচিং সেন্টারের সহায়তা না কিনেই, নানা রকম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় শীর্ষে থাকবেন উচ্চবর্ণের মানুষেরা, অথবা দলিত-আদিবাসীরও আর্থিক সঙ্কুলান থাকবে এই সব সহায়তা পাওয়ার, সে দিন নয় মেধাভিত্তিক যোগ্যতার কথা তোলা যাবে। প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিক্যাল কলেজে ক্যাপিটেশন ফি দিয়ে সিট কিনেছেন, এমন ক’জন দলিত বা আদিবাসীকে আপনি চেনেন? তাই বলি, অনুকূল পরিবেশে অনগ্রসর শ্রেণির মানুষরাও মেধাজাত যোগ্যতায় পিছিয়ে থাকবেন না।
এই যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে, অযোগ্য, মেধাহীন ছোট জাতগুলো জেনারেলদের ভাগের ক্ষীর-ননি, চপ-কাটলেট মুখের সামনে থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল, তথ্য থেকে তার কতটা সমর্থন মেলে? ২০১৪-১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তফসিলি জাতিভুক্ত অধ্যাপক ছিলেন ছয় শতাংশ, তফসিলি জনজাতিভুক্ত অধ্যাপকের সংখ্যা এক শতাংশেরও কম (০.৯১)। একটি তথ্যের অধিকার মামলায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য (২০১৮) অনুসারে, ভারতের ৪০টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকদের পদে যথাক্রমে ৯৫ শতাংশ ও ৯২ শতাংশই ‘জেনারেল ক্যাটেগরি’। কেন্দ্রের বিভিন্ন মন্ত্রক, রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির দফতর, নীতি আয়োগ, রেল এমন নানা বিভাগের গ্রুপ এ এবং গ্রুপ বি শ্রেণির কর্মচারীদের যে তথ্য মিলেছে, তাতেও বর্ণহিন্দুদের আধিক্য অতি স্পষ্ট।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত হয়ে বাবাসাহেব অম্বেডকর গণপরিষদে গিয়েছিলেন। যে রাজ্যকে জাতপাত বৈষম্যের ঊর্ধ্বে, সাম্যবাদের স্বপ্নরাজ্য বলে প্রচার করা হয়। তথ্য কিন্তু বলছে, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে জাতিবর্ণ-বৈষম্যের প্রথা কিছুমাত্র অপসারিত হয়নি। ১৯৬৭-৬৯ সালের বিধানসভায় প্রথম তফসিলি জাতি এবং জনজাতির মোট সদস্য ছিল ১১ শতাংশ , উচ্চবর্ণের সদস্য ৬১ শতাংশ। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেস শাসনের শেষে ওই বিভাজন ছিল ১৪ শতাংশ ও ৪৪ শতাংশ। ২০১১ সালে বামফ্রন্ট শাসনের শেষে ২৫ শতাংশ ও ৪২ শতাংশ। ২০১৬ সালে গঠিত বিধানসভায় ১৪ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ । এক্কেবারে ভদ্রলোকের এক কথা। ১৯৭৭ সালে যা, ২০২০-তেও প্রায় তাই।
প্রচ্ছন্ন ভাবেই হোক বা প্রকট ভাবে, সংরক্ষণ-বিরোধী মনোভাব জাতবিভাজিত সমাজের আরশি। ‘ছোটলোক’ বা ‘নিচুজাত’-এর প্রতি ভদ্রলোকের চিরকালীন সামাজিক দূরত্ব রক্ষার মনোভাব জাতিবৈষম্যের সুগভীর শিকড়ের প্রমাণ দিয়েছে বারংবার। ‘জেনারেল ক্যাটেগরি’-র মানুষজন জাত্যভিমান আগলাতে আগলাতে নিরুদ্বেগে নিদ্রা যেতেই পারেন। আমরা বামন হয়ে হাত বাড়িয়ে চাঁদকে কলঙ্কিত করব না। তবে, দলিত এবং আদিবাসীদের প্রতি জাতিবিদ্বেষ অহরহ রক্তক্ষণ ঘটায় মনের গহিনে। এই অবমাননা আমাদের আত্মগ্লানি ও হীনম্মন্যতার দিকে ঠেলে দিয়ে নির্বাক করতে চায়। তা বলে আমরা নালিশ জানিয়ে যাইনি, এমন অপবাদ আর বাপু দিতে পারবেন না। বিচারের বাণী যে নীরবে, নিভৃতে আমাদের জন্য কাঁদবে না সেটাও অবশ্য আমাদের জানা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy