এই প্রথম বাড়ি ছাড়তে হল বাধ্য হয়ে। ঘোর করোনাকালে অন্য কারও বাড়ি যাওয়া মুশকিল। আমার একটি মুশকিল আসান জুটে গেল ভাগ্যিস! অনেকেরই সে সৌভাগ্য হয়নি। আড়াই দিন অন্ধকারে থাকার পরও যখন আলো আসা দূর অস্ত্, কাউকে খবরই দেওয়া যায়নি, সিদ্ধান্ত নিতে হল বাড়ি ছাড়ার। কারণ গরম বাড়ছে। বাড়ির অবিন্যস্ত অবস্থা। অন্ধকার নামলে নারকীয় দশা। জল বুঝে খেতে হচ্ছে। শেষে বোঝা গেল তাতেও কুলোবে না। বিপদ মানুষকে সাহসী করে, সহিষ্ণু করে, আত্মীয় অনাত্মীয় চিনিয়ে দেয়। তবু যখন পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে আসছি, ছেলেরা অপটু হাতে গাছ কাটতে উদ্যত। কারণ কোন এক ইনস্পেক্টর হ্যামলিন যেন বলে গিয়েছেন, গাছ কাটলে বিদ্যুতের আশা আছে। পাতায়, ডালে, কাঁচা আমে রাস্তাটা একেবারে বনপথ। তবে ফুলে ফুলে নয়, ক্লান্তি আর হতাশায় ঢাকা। সেই সব ডালপালা পার হচ্ছি আর রাস্তার দু'পাশের বাড়ি, বারান্দা, ছাদ থেকে প্রশ্ন ভেসে আসছে, ‘‘চলে যাচ্ছেন?’’ পা সরছিল না। মনে হচ্ছিল, প্রিয়জনকে যেন ফেলে পালাচ্ছি।
এক সন্ধ্যার ঝড় আর কয়েক মাসের ভাইরাস প্রমাণ করে দিল, প্রকৃতির বিপুল শক্তির সামনে মানুষ আসলে অসহায়। এত দিন চাল, ডাল, তরিতরকারি, মাছ, মাংস সংগ্রহ করে বিজয়ীর মতো মনে হচ্ছিল নিজেকে। এই বার ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা, বিদ্যুৎবিহীন রেফ্রিজারেটরের মধ্যে সেগুলোই পচনযোগে পড়ে গেল। সামাজিক দূরত্বের তাগিদে মানুষকে দূরে ঠেলতে বাধ্য হচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হল, কাছের মানুষের এত অভাব কেন?
অনেকেই সরকার, বিরোধী, আমলা, সিইএসসি ইত্যাদিকে কড়া কড়া শব্দবাণ নিক্ষেপ করে নিজেকে চাঙ্গা রাখছিলেন। ক্রমশ তাঁরা নিস্তেজ হয়ে এলেন। কেবল ক্ষুধা, তৃষ্ণা, অন্ধকারে কাতর হয়ে নয়। মাঝে মাঝে মোবাইলে উঁকি দিয়ে যাওয়া টাওয়ার ও নেটের দৌলতে তাঁরা বুঝতে পারছিলেন, চার পাশে কী হয়ে গেছে। গ্রামের পর গ্রাম উধাও। বিদ্যুতের খুঁটি কাঠির মতো ভেঙে পড়েছে। রাস্তা যেন নদী। বাঁধ ভেঙে গেছে।
ধৈর্যের বাঁধও ভেঙে গেছে। কিন্তু কাকেই বা দোষ দেওয়া চলে? অনেক ত্রুটিবিচ্যুতির হিসাব নিয়েও বলা যায়, আসলে নিষ্ঠুর নিসর্গের সঙ্গে পেরে ওঠা যায়নি। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোই পারেনি। নিসর্গ কি নিষ্ঠুর? না কি আমরা তার উপর বড় বেশি নিষ্ঠুরতা করেছি? এই সব আলোচনা হচ্ছিল রাস্তার কলতলায়। পাশের ফ্ল্যাটের চার বা পাঁচতলার যে বাসিন্দারা কোনও দিন দেখা হলে একটুকরো হাসি ভিন্ন কিছুই দেননি, তাঁরা সকলেই এখন কলতলার ভিড়ের শরিক।
সকলেরই দুটো প্রশ্ন। ভ্যাকসিন কখন আসবে? আর কারেন্ট? কেউ এক জন প্রশ্ন করলেন, ‘‘মাস্ক পরেননি?’’ উত্তর এল, ‘‘আর মাস্ক! করোনা টরোনা এই ঝড়ের মধ্যে চলে না।’’ স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের এই অসাধারণ সত্য শোনার পর প্রশ্নকর্তা চুপ হয়ে গেলেন। তারপর চিবুক দিয়ে দাড়ির মতো ঝুলতে থাকা মাস্কটায় হাত বুলিয়ে সম্ভবত স্বাস্থ্যবিধির স্মৃতিচারণ করলেন।
এই নারকীয় পরিস্থিতিতে ঈশ্বরের নাম কেউ খুব একটা নিচ্ছেন না। মনে হয়, ঝড় এবং লোডশেডিঙের পিছনে ঈশ্বরের হাত থাকতে পারে ভেবে সন্দেহ করছেন যে, সমস্যা সমাধানে তিনি বিশেষ ভূমিকা নেবেন না।
উল্টো দিকে এক মহিলা একা থাকেন গুরুতর অসুস্থ জীবনসঙ্গীকে নিয়ে। তাঁর ওষুধ, ইঞ্জেকশন সব বন্ধ ফ্রিজে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি অসহায় রব তুলছিলেন, ‘‘পাড়ায় কোনও ছেলে নেই? যেতে তো পারে এক বার সিইএসসি অফিসে? এদের কোনও সেন্স নেই!’’ আমরা তাঁর রাগ শুনছিলাম। কাছে গেলে গলার কাছের ফুলে ওঠা শিরায়, চোখের কোলে নির্ঘুম অন্ধকারে তাঁর অসম্ভব অসহায়তাটাও দেখতে পেতাম।
শুনছি সারা দেশ আমাদের পাশে আছে। বিশ্বের দরবারেও না কি আলোচিত হচ্ছে আমাদের দুরবস্থার কথা। বন্ধুর বাড়ি এসে পাখার তলায় বসে তাই খানিক নিশ্চিন্ত লাগছিল। নেট খুলতেই খবর দেখলাম, পরিযায়ী শ্রমিক খিদে সহ্য করতে না পেরে পথের পাশে মরা কুকুরের মাংস খাচ্ছেন। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ জি টি রোডে প্রচুর মানুষ একত্রিত হয়ে গেলেন। গাছের ডালপালা টেনে রাস্তা আটকে দিলেন তাঁরা।
পঞ্চাশ ঘণ্টার ওপর কারেন্ট নেই। দুধারের গাড়ি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। মাঝখানে অ্যাম্বুল্যান্স, শববাহী গাড়ি। অবরোধকারীরা চেষ্টা করলেন, সেগুলোকে পথ করে দিতে। জুটে গেল কিছু পেশি-নির্ভর মানুষও। শেষে পুলিশের উত্তপ্ত শাসন। কেউ বুঝতে পারছিলেন না, কার পক্ষ নেবেন। গলির অন্ধকার থেকে কারা যেন পাথরও ছুটে আসতে দেখলেন। সাধারণ মানুষ অসহায়। রাস্তাও তো আটকে রাখা যায় না?
আঙুল তুলতে গিয়ে লাভ হচ্ছে না। প্রশ্নগুলো ফিরে ফিরে নিজের দিকেও আসছে। সভ্যতা তাহলে করল কী? লোভী আধুনিকের অসভ্যতাও তো কম নয়? মাঝখানে পড়ে রইল এই ভয়ংকর দিনকটি। লকডাউনের লাল চোখ না দেখলে কোভিড দেখতে হয়। ঝড় সামলাতে গেলে সামাজিক দূরত্ব লোপাট হয়ে যায়। সিস্টেমের দিকে দৃষ্টি ফেরালে প্রকৃতি হাসে। প্রকৃতিকে দোষ দিলে নিজে নির্দোষ থাকা যায় না। অন্ধকার রান্নাঘরে পেঁয়াজের ঝুড়ির উপর দিয়ে অনিশ্চয়তা হেঁটে যায়। ডিপ ফ্রিজ থেকে অশুভ যাপনের পচা গন্ধ আসে।
তাও তো আমরা খেতে পাচ্ছি। যাঁরা সেটুকুও পাচ্ছেন না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy