গত ৩০ জুলাই, ২০১৯-এ রাজ্যসভায় তালাক বিল পাশ হল। এর আগে লোকসভায় অনুমোদিত হয়েছে তালাক অর্ডিন্যান্স বিল। কী বলা হয়েছে ওই বিলে? ওই বিলে তাৎক্ষণিক তিন-তালাককে ফৌজদারি তকমা দেওয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিক তিন-তালাক হল একক সিদ্ধান্তে স্বামী হঠাৎ করে স্ত্রীকে তিন বার তালাক উচ্চারণ করে বা লিখে বিবাহ নামক চুক্তিকে বাতিল করে দিতে পারেন। ইসলাম ধর্মে বিবাহ-বিচ্ছেদের নাম হল ‘তালাক’। যখন নিকাহ বা বিবাহ নামক চুক্তি সম্পন্ন হয়, তখন মেয়েটির অভিমত নেওয়া হয়, তাঁর তিন বার ‘কবুল’ উচ্চারণে নিকাহ সম্পন্ন হয়, কিন্তু তাৎক্ষণিক তিন তালাকে স্বামী একতরফা দুম করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিকাহ বাতিল করলে তার নাম হয় ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’। স্বভাবতই এর বিরুদ্ধে ভারতে আন্দোলন দানা বাঁধে। সুবিচার চেয়ে মামলা হয় সুপ্রিম কোর্টে। ইসলাম ধর্মে যে তিন প্রকার তালাকের কথা আছে, তার মধ্যে নিকৃষ্টতম হল এই তালাক, যার পোশাকি নাম তালাক-এ-বিদা।
ইসলামি ধর্মশাস্ত্রে তালাকের এক-একটি পর্যায়কে অন্তত ১৫ দিনের হতে হয়। সর্বোত্তম তালাককে সেখানে বলা হয়েছে— তালাক-এ-আহসান। সেখানে এক তালাক দিয়ে এক ‘তুহুর’ অর্থাৎ কমপক্ষে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে। ইদ্দত (অপেক্ষা কাল) পূর্ণ হলে আবার বাকি দুই তালাক। এই ভাবে তিন-তুহুর পার হলে বিচ্ছেদ কার্যকরী হয়। পরে ইচ্ছে করলে স্ত্রী বা পুরুষ অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারেন কিংবা নিজেরা পুনর্বিবাহ করতে পারেন।
দ্বিতীয় তালাক হল, তালাক-এ-হাসান বা উত্তম বিচ্ছেদ। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক তুহুরে এক বার বিচ্ছেদ হবে। এই ভাবে তিন তুহুরে তিন তালাক দিয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ হতে পারে। এমন বিচ্ছেদে স্ত্রী স্বামীর জন্য অবৈধ হয়ে যাবে। ওই স্ত্রী পূর্বতন স্বামীকে পুনর্বিবাহ করতে পারবেন না। ওই মহিলাকে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে, যাকে ‘নিকাহ হালালা’ বলা হয়। ওই স্বামী যদি মারা যান বা স্ত্রীকে তালাক দেন, তবে ওই মহিলা প্রাক্তন স্বামীকে বিবাহ করতে পারেন।
তৃতীয় প্রকার বিচ্ছেদ হল, বিদায়াত তালাক। এক সঙ্গে তিন বার তালাক বলে বিচ্ছেদ ঘটানো। এ ক্ষেত্রে তালাকদাতা অবশ্যই পাপ করছে বলে ইসলামি আইনশাস্ত্র মনে করে। এই তালাকের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন ভারতীয় মুসলিম মহিলাদের একটি অংশ। তাঁরা সেই মর্মে সর্বোচ্চ আদালতে মামলাও করেন। ২০১৭ সালের অগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্ট ওই মামলার রায় ঘোষণা করে। পাঁচ জন বিচারপতি একমত হননি। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের মত মেনে নিয়ে রায় ঘোষিত হয়। দু’জন বিচারপতি— জে এস খেহর এবং এস এ নাজির তাৎক্ষণিক তালাক প্রথা ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে সরকারকে আইন প্রণয়নের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিন জন বিচারপতি (জাস্টিস জোসেফ, নরিম্যান ও ললিত) তাঁদের ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী রায়ে বলেছিলেন, তাৎক্ষণিক তিন তালাক অসাংবিধানিক ও অ-ইসলামীয়। পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের কথা তাঁরা বলেননি। সেই সময় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ জানিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় যেহেতু এই তালাককে বাতিল করা হয়েছে, তাই পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের কোনও প্রয়োজন নেই। কোর্টের নির্দেশ না মানা হলে দেশের যে গার্হস্থ্য আইন রয়েছে সেই মোতাবেক দোষীর বিচার ও শাস্তি হবে।
নতুন তালাক বিলে স্পষ্টতই সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের রায় (যেটি প্রকৃত রায় বলে গৃহীত) গ্রহণ না করে, অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টকে অগ্রাহ্য করে পার্লামেন্টে তালাক বিল পাশ করলেন। সংসদের দুই কক্ষে বিলটি অনুমোদনও পেল। তাৎক্ষণিক তিন তালাক অবৈধ, অসাংবিধানিক— সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় সত্ত্বেও নতুন করে সংসদে আইন প্রণয়নের দরকার ছিল না। কারণ একটাই, সেটা হল—তাৎক্ষণিক তালাক দেওয়া স্বামীকে শাস্তির আওতায় আনা।
যে কোনও একতরফা বিবাহ বিচ্ছেদ (তাৎক্ষণিক তিন তালাকও তাই) অন্যায়। তা হলে শুধু মুসলিম পুরুষের জন্য এই আইন কেন? এই দেশে প্রায় প্রত্যেকটি ধর্মের নিজস্ব দেওয়ানি বিধি আছে, কেবল মাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা এই সুবিধা ভোগ করেন, এমন নয়। এবং এই সমস্ত দেওয়ানি বিধির সর্বোচ্চ অভিভাবক হল সুপ্রিম কোর্ট। সেই সুপ্রিম কোর্ট যখন তাৎক্ষণিক তিন তালাককে অবৈধ, অসাংবিধানিক ও অ-ইসলামীয় হিসাবে ঘোষণা করেছে, তখন তালাক অর্ডিন্যান্স বিল সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে যায়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এমন একতরফা বিচ্ছেদের ঘোষণাকে শূন্যগর্ভ বলা হয়েছে। কেউ যদি এমন বিচ্ছিন্নতার কথা ঘোষণা করে তবে তাকে ফৌজদারি অপরাধীর তকমা দিয়ে গারদে পোরার কথা সর্বোচ্চ আদালত বলেনি।
২০১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী, এই দেশে স্বামী-পরিত্যক্তা (আইনগত ভাবে নয়) মহিলার সংখ্যা হল ২৩ লক্ষ ৭০ হাজার। তাঁরা কিন্তু আইনিভাবে বিচ্ছিন্না নন। তাঁদের মধ্যে ১৯ লক্ষ হলেন হিন্দু এবং ২.৮ লক্ষ হলেন মুসলিম। ফলে দেখা যাচ্ছে, সব ধর্মের পুরুষেরা এমন অন্যায় সুযোগ নিয়ে থাকেন। যদি একে ফৌজদারি অপরাধ বলা হয়, তবে কেন সব ধর্মের মানুষের ক্ষেত্রে বলা হবে না— এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কেউ বলতে পারেন, অন্য ধর্মে ‘তালাক তালাক তালাক’ বললেই তো বিচ্ছেদ হয় না, তা হলে তাদের কেন এই ফৌজদারি অপরাধের অন্তর্ভুক্ত করা হবে! এখানে মনে রাখা দরকার, ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যেও অগস্ট ২০১৭ থেকে তাৎক্ষণিক তিন তালাক আর নেই। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট তাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। তা হলে কেন শুধু মুসলিম পুরুষের ক্ষেত্রে এই আইন? নানা ধর্মের বিপুল সংখ্যক নারী স্বামীর কাছে আইনি ভাবে বিচ্ছিন্না না হয়েও পরিত্যক্তা, তাঁরা কেন সুবিচার পাবেন না, কেন ওই স্বামীরা অপরাধী বলে গণ্য হবেন না? বলতেই হয়, এই বিল একদেশদর্শী এবং সাম্যের বিরোধী।
তালাক বিলে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে ফৌজদারি ও অ-জামিনযোগ্য অপরাধ বলা হয়েছে। এমন আইন সব একতরফা বিচ্ছেদের ক্ষেত্রেই কি ঘোষণা করা জরুরি ছিল না? শাস্তিতত্ত্বের নিয়ম অনুযায়ী, চরম অনিবার্যতা না থাকলে দণ্ড দেওয়া উচিত নয়। যে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে, তাকে ফৌজদারি অপরাধের আওতাভুক্ত করা শাস্তিতত্ত্বের বিরোধী, ন্যায়বুদ্ধির পরিপন্থী। মহাভারতে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন— দণ্ডেন সহিতা হ্যেষা লোকরক্ষণকারিকা। দণ্ড যখন ন্যায়বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন তা জগতের মঙ্গলসাধন করে।
বিখ্যাত দার্শনিক ও আইনজ্ঞ জেরেমি বেন্থাম বলেছিলেন, তিন জায়গায় ফৌজদারি আইন ব্যবহার করা যাবে না। অন্যতম হল, যেখানে কুকর্মের থেকে শাস্তির ওজন বেশি। যিনি স্ত্রীকে কলহের সময় বেশ কয়েক বার বললেন— বিচ্ছেদ, বিচ্ছেদ, বিচ্ছেদ (তালাকের অর্থ বিচ্ছেদ), আর তাঁর তিন বছরের জেল হয়ে গেল— এখানে কুকর্মের থেকে শাস্তির ওজন অনেক বেশি, যা ন্যায়ের পরিপন্থী।
এ দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নেই। কিন্তু অভিন্ন ফৌজদারি বিধি আছে। তা হলে তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিলে মুসলিম পুরুষকে যে ফৌজদারি অপরাধের তকমা দেওয়া হল, তা ফৌজদারির বিধির অভিন্নতাকে বড়সড় ধাক্কা দিল। যে কোনও একতরফা বিচ্ছেদ কাম্য নয় এবং তার জন্য আইন দরকার। সেই আইন ফৌজদারি নয়, তা হওয়া উচিত দেওয়ানি বৈবাহিক অপরাধ।
দর্শনের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy