Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
COVID-19

Covid 19: হাতের কাছে উদাহরণ নেই, কোভিডে ধ্বস্ত অর্থনীতির সমাধানও তাই খুঁজতে হবে সবাইকে

সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি বা সিএমআইই-র সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের  ৯৭ শতাংশ বলেছেন তাঁদের আয় কমেছে।

গ্রাফিক: সন্দীপন রুইদাস।

গ্রাফিক: সন্দীপন রুইদাস।

সুপর্ণ পাঠক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২১ ২১:৪৮
Share: Save:

প্রথম ঢেউয়ের ছোবলে আমরা অনেকেই অনেক কিছু হারিয়েছি। কিন্তু কোথাও গিয়ে মনের কোণে একটা আশাও ছিল। মনে হয়েছিল, আর তো কিছু দিন। তারপর আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ বুঝিয়ে দিয়েছে জীবন বদলে গিয়েছে আমূল। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের। সংবাদের শিরোনামের পরিসংখ্যান এখন ব্যক্তি মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনের চ্যালেঞ্জ।

সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি বা সিএমআইই-র সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের ৯৭ শতাংশ বলেছেন তাঁদের আয় কমেছে। প্রতিদিনই আতঙ্কে ভুগছেন যা আছে সেটুকুও থাকবে কি না! মল্লিকপুর সোনারপুর অঞ্চলে ট্রেনে কর্মস্থলে যেতে না পারার আতঙ্কপ্রসূত অসহায় রাগের যে ছবি দেখলাম তা কিন্তু এই সমীক্ষার উপর সিলমোহর। প্রসঙ্গত উল্লেখ থাক যে দ্রেজ়ের মতো অনেক অর্থনীতিবিদই এই সমীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতিযুক্তিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা অন্য প্রশ্ন। নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা কোভিড উত্তর জীবন যাপন কতটা কঠিন হয়ে উঠছে তা তো উপলব্ধি করেই চলেছি।

উল্টোদিকে, আমরাও কোভিড বিধি মানার ব্যাপারে গুঁতো না খেলে সতর্ক নই। প্রথম ঢেউয়েই আকছার মানুষ ‘বড় লোকের রোগ’ বা ‘গরিবদের হবে না’, এই যুক্তিতে কোভিড বিধি ওড়াতে দেখেছি আমরা। কিন্তু যখন কোভিড আর্থিক অবস্থান না-মেনেই প্রাণ নিতে শুরু করল, তখন মাস্কের ব্যবহারের মধ্যে অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা গিয়েছে।

কিন্তু সরকারও তো আতান্তরে। রাশ ঢিলে দিলে যে আমরা যে খুব কোভিড বিধি মানব তারও কোনও গ্যারান্টি নেই। তাই ট্রেন বন্ধ। আর টিভি খুললেই তৃতীয় ঢেউ ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে কি না তা নিয়ে আলোচনা।

যাঁরা চাকরি দেন তাঁদের মধ্যে ক্ষুদ্র এবং অতি ক্ষুদ্র সংস্থাই সংখ্যায় বেশি। তারাও আতান্তরে। পার্ক সার্কাসে যাঁর কারখানা, তাঁর শ্রমিক হয়ত আসেন মল্লিকপুর থেকে। এঁদের বাড়ি থেকে আনানোর জন্য পরিবহণের ব্যবস্থা করার রেস্ত তাঁর নেই। তিনি কী করবেন? হয় কারখানা বন্ধ করে রাখতে হবে, নয় এঁদের ছেড়ে ঘরের কাছের শ্রমিককে নিয়োগ করতে হবে। তাহলে মল্লিকপুরের শ্রমিক তো বেকার হয়ে যাবেন! কী খাবেন তিনি?

একই প্রশ্ন কিন্তু মালিকদের মুখেও। তাঁরা বলছেন, প্রথম ঢেউয়ে ঘরের টাকা দিয়ে শ্রমিকদের যা হোক পুষিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বছর না ঘুরতেই দ্বিতীয় ঢেউয়ে তাঁরাও তো নাজেহাল। মল বন্ধ। কিন্তু মলের দোকানের ভাড়া চোকাতে হচ্ছে। কাঁচা মাল যে আনবেন তার পরিবহণের বিধিনিষেধের জটিলতা মানা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। ক্রেতার হাতে পয়সা নেই। নিতান্ত প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া তাঁদের হাত আর অন্য পণ্যের দিকে বাড়াতে সাহস করছেন না। উৎপাদনের উপর রাশ টানতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। আর উৎপাদনের উপর রাশ মানেই শ্রমিকের কাজ হারানো। আতান্তর বাড়ছেই।

শ্যাম রাখি না কূল। আর্থিক ক্ষেত্রে এই দ্বন্দ্ব বাড়ছেই। বাড়ছে নীতি নির্ধারণের উপর চাপও। একদিকে আয় কমছে অন্যদিকে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। বাড়ছে চিকিৎসার খরচও লাগামছাড়া গতিতে। হাতে যেটুকু থাকছে তাও খরচ করতে দু’বার ভাবতে হচ্ছে চাকুরিজীবী সাধারণ নাগরিককে।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সমীক্ষাও সমর্থন করছে এই দুরাবস্থার। জাতীয় উৎপাদনের অনুপাতে গার্হস্থ্য সঞ্চয়ের হার ক্রমশ পড়ছেই। গত অর্থ বছরের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে এই হার ছিল ২১ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বরে ছিল ১০.২ শতাংশ আর অক্টোবর-ডিসেম্বরে তা মুখ থুবড়ে পড়েছে ৮.২ শতাংশে।

উল্টোদিকে মানুষের দেনার দায় বাড়ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের শুরুতে গড় জাতীয় উৎপাদনের নিরিখে গার্হস্থ্য দেনার হার ছিল ৩১.৮ শতাংশ। গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭.১ শতাংশে। আর তা আরও বেড়ে অক্টোবর-ডিসেম্বরে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৭.৯ শতাংশে।

দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন। আয় কমছে, কিন্তু খরচ বাড়ছে। যে ডিম কয়েক মাস আগেও ৪ থেকে ৪ টাকা ৫০ পয়সা ছিল, তা এখন ৬ টাকা ছাড়িয়েছে। দৈনন্দিন ওষুধের খরচও আকাশের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। বাড়ছে পেট্রল, ডিজেল আর গ্যাসের দাম। কিন্তু আয় কমছে। কিন্তু ঝপ করে খরচ কমানো কি সম্ভব। তাই সঞ্চয় কমছে কিন্তু বাড়ছে দেনা। কারণ, নিত্য প্রয়োজন তো মেটাতেই হবে। হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ মেটাতেই হবে। মাথায় রাখতে হবে এই পরিসংখ্যানে কিন্তু ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র সংস্থার মালিকরাও অংশীদার। তাঁদের অবস্থাও কিন্তু তথৈবচ।

আর এই অবস্থার যে দ্রুত উন্নতি হবে তারও কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। উল্টে বৃদ্ধির হার নিয়ে সকলে কিন্তু একটু সংশয়েই আছে। এস অ্যান্ড পি চলতি অর্থ বছরে ১১ শতাংশ বৃদ্ধি হবে বললেও, সম্প্রতি তা কমিয়ে ৯.৬ শতাংশের আশায় আছে। মুডি’জও ১৩.৯ শতাংশ থেকে পূর্বাভাস ৯.৬ শতাংশে নামিয়েছে।

এখানে যে ভাবনাটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল বৃদ্ধির পূর্বাভাস অনুযায়ী সংখ্যা নিয়ে ভাবনা। এই হার যদি বাড়ত তা হলে ভেবে নেওয়ার জায়গা থাকত যে আমাদের অর্থনীতি নিয়ে সংস্থাগুলি আশাবাদী। পূর্বাভাস বেশির ভাগ সময়ই মেলে না। কিন্তু পূর্বাভাসের পরিবর্তন অর্থনীতি নিয়ে সামগ্রিক ভাবনার একটা নির্দেশক হিসাবে মানা হয়। আর পূর্বাভাসে ভারতের অর্থনীতি নিয়ে যে নৈরাশ্যের ছাপ দেখা যাচ্ছে তা কিন্তু সংশয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এটাও মাথা রাখা জরুরি যে কোভিডের কারণে অর্থনীতির যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার কোনও নিকট উদাহরণ আমাদের ইতিহাসে নেই। নীতি নির্ধারকদের সামনেও কিন্তু কোনও পাঠ্যপুস্তক নেই যাতে বলা আছে এই পরিস্থিতিতে এই ভাবে হাঁটতে হবে। বাজার খুললে কোভিড ঢেউ আর বন্ধ রাখলে ক্ষুন্নিবৃত্তিটাই চ্যালেঞ্জ। অন্য ভাবে দেখলে পছন্দটা কি মৃত্যুর মিছিলে হাঁটা না দেনার দায় থেকে মুক্তি পাওয়া। এই সিদ্ধান্তের সব দায় কিন্তু শুধু নীতি নির্ধারকদের নয়। আমাদেরও দায় কম নয়। কে কী ভাবে তা পালন করব তাই কিন্তু আমাদের ভবিষ্যতের নির্ণায়ক হয়ে উঠবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Jobs economy COVID-19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy