প্রতীকী ছবি।
বেলা তখন অনেক। হাঁড়ি, গামলা, বাসনপত্র সব ধোওয়ামাজা শুরু হয়ে গিয়েছে। দোকানে যে খাবার কিছু নেই, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এত খিদে পেয়েছিল যে, দোকানি ‘আর হবে না’ জানিয়ে দিলেও চেপে ধরেছিলাম— ‘দেখুন না একটু!’
ড্রামের জলে হাত ধুয়ে সে দিকে তাকিয়েই আমি বসে পড়ি ঝুপড়ি দোকানের কাঠের বেঞ্চে। সকাল থেকে চা ছাড়া কিছু খাওয়াও হয়নি আমার। হাতের তালুতে থালার ভাতের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছিলেন ভদ্রলোক। কে খাবেন, তাকে না চিনেও পরমাত্মীয়ের মমতা তাঁর সেই স্পর্শে।
এ ঘটনা কম-বেশি এক বছর আগের। এই রকমই গরমের এক দুপুরে খড়্গপুর স্টেশনের সেই ভদ্রলোকের মুখ মনে পড়ছে আমার। জলের মতো ডাল, তিন-চার রকম আনাজ মিশিয়ে ভাজা আর একটা ওমলেট। সঙ্গে এক ফালি পাতিলেবুও।
অফিসের নানা রকম কাজ নিয়ে বছরে বহুবার এ-মাথা ও-মাথা করি। দার্জিলিং থেকে সুন্দরবন, বনগাঁ থেকে বেলপাহাড়ি— সব জায়গায় ভাত বেড়ে দিয়েছেন যাঁরা, এ ক’দিন তাঁদের মুখগুলো মনের মধ্যে ঘুরছে, যাঁরা আমায় খেতে দিয়েছেন।
এঁদের কেউ-ই আমার চেনা নন। খাবারের পয়সা দিয়েছি ঠিকই। তবে, তাঁদের যে ভুলতে পারিনি, তা বুঝতে পারছি এই সঙ্কটের সময়।
আরও পড়ুন: করোনা: ভয়ের পাশাপাশি আমাদের আয়নার সামনে দাঁড়ানোরও সময়
ঝাড়গ্রামে একদিন
ভোটের আগে জেলা ঘোরার কাজ থাকে। তেমনই গত এপ্রিলে ঘুরতে গিয়ে সেই তরুণটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঝাড়গ্রামের লজে। হাড়সার ছেলেটাকে ভুলি কেমন করে! ঝাড়গ্রাম স্টেশনে নেমে ডান দিকে আনাজ আর মাছের বাজারের মধ্যে দিয়ে এগোলে সাদামাঠা একটা লজ। সেখানে ব্যাগ রেখে দু’দিন দু’বেলা জেলা ঘুরে চলে যেতে হবে পুরুলিয়া।
সেখানেই এক রাতে আমায় খেতে দিয়েছিলেন তিনি। খুঁজে-পেতে আমার জন্য চারটে রুটি আর ডিমের ঝোল নিয়ে এসেছিলেন। সঙ্গে পেঁয়াজ-লঙ্কা।
এই রকম খাদ্যহীন তখন ছিল না চারপাশ। তবে, ফিরব বলে না যাওয়ায় অত রাতে সেই রুটি-ডিম জোগাড় করতে ঘাম ছুটে গিয়েছিল তাঁর। সেদিন সকাল ৭টা থেকে মোটরবাইকেই ছিলাম চিত্রসাংবাদিক দেবরাজ ঘোষের সঙ্গে। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে বেলপাহাড়ি, সেখান থেকে কাঁকড়াঝোড় হয়ে ঝিলমিল মোড়। এবং একই পথে রাতে শহরে ফেরার পর সম্ভবত চেহারায় খিদে ফুটে উঠেছিল আমাদের দু’জনের। ভোটের আঁচ থাকায় সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গেই ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল সব। তার মধ্যেও খাবার নিয়ে এসেছিলেন তিনি।
তখন ভাবিনি। এখন মনে হচ্ছে, তাঁর নিজের জন্য রাখা রাতের খাবারটাই কি খেয়েছিলাম সেদিন? তিনিও কি সেই আত্মীয়তার বোধেই আমাদের অভূক্ত রাত বদলে দিয়েছিলেন নিজের ভাগের খাবার এগিয়ে দিয়ে?
আরও পড়ুন: গুমোট ঘরবন্দির মধ্যে হালকা হাওয়ার ঝলক, কিন্তু সংশয় রইল কিছু
রায়গঞ্জের সেই বৃদ্ধ
হাটুরে হোটেল। রায়গঞ্জ বাজারে। হোটেলের বৃদ্ধ কী করেছিলেন? অবেলায় আর ভাত হবে না বলায় সহকর্মীর উপর কী মেজাজই না দেখিয়েছিলেন! বাজারের মধ্যে এই হোটেলে খাবারের চাহিদা বোর্ডারের চেয়ে বেশি। তার উপর এখানেও আমি সেই একই ভুল করেছিলাম।
সকালে টিফিন করে একটা মিটিংয়ের জন্য বেরিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর সেই মিটিং শেষে এর-ওর সঙ্গে দেখা করে, অফিসের কাজ মিটিয়ে যখন ফিরলাম, তখন বেলা গড়িয়ে গিয়েছে অনেকটা। বাজার উঠে গিয়েছে। হোটেলেও হেঁসেল ধোওয়ার কাজ হয়ে গিয়েছে।
রায়গঞ্জ শহরে সেই আমার প্রথম যাওয়া। পা রাখার সময়ই দুর্যোগে ছিলাম। কলকাতা থেকে রাতের বাসে রায়গঞ্জে পৌঁছলেও বৃদ্ধের আত্মীয়তাবোধেই সেদিন ভাত তো এসেছিলই, সঙ্গে ছিল আলুর টুকরো আর ঝোলমাখা একটা পাতলা
মাছের টুকরোও।
কার ভাগেরটা দিয়েছিলেন ভদ্রলোক সেদিন আমায়? মনের মধ্যে সেই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে এই ক’দিন।
রাতের পাহাড়ে ধোঁয়া
একবার নানা বাধা টপকে সন্ধেবেলা পৌঁছেছিলাম অশান্ত দার্জিলিংয়ে। গাড়িঘোড়া, দোকানপাট সব বন্ধ। পাতলেবাসের বাসিন্দা এক পরিচিতের চেষ্টায় ম্যালের একটা হোটেলের দরজা খুলল ঠিকই, কিন্তু টানা বন্ধের ফলে সেখানে খাবার কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। হোটেলে ব্যাগ রেখে কাজে বেরিয়ে পড়েছিলাম। চারদিক বন্ধ শুধু নয়, বিক্ষোভের জেরে বেশ টানটান শহর ও আশপাশের এলাকা।
কিছুটা গাড়িতে, কিছুটা হেঁটে কাজ সেরে সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে জানতে পারলাম, ভাঁড়ার শূন্য। এক কাপ চা পর্যন্ত করে দিতে পারবেন না কর্মচারী। তাঁরাও প্রায় অভূক্তই। সে সব শুনে খিদে-পেটেই রাত কাটাতে হবে বুঝে গিয়ে ঘরে ঢুকলাম।
অনেক রাতে দরজায় টোকা। গিয়ে দেখি, একটা বাটিতে গরম খিচুড়ি নিয়ে হাজির এক কর্মচারী। ধোঁয়াওঠা সেই খিচুড়ি পরিমাণে সামান্যই।
কিন্তু খিদেপেটে সেই বাটি হাতে নিয়ে শরীরের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভুতি হয়েছিল!
সেই খিচুড়ি কার ভাগের থেকে দেওয়া হয়েছিল, জানতে পারিনি। কারণ, সকালে উঠেই পথে বেরিয়ে পড়েছিলাম। পরে যতবার দার্জিলিংয়ে গিয়েছি, ম্যালে দাঁড়িয়ে সেই রাতের কথা মনে পড়েছে।
চরমেঘনার মা
মাস-ছয় আগে নদিয়ার করিমপুরে গিয়েছিলাম। বিধানসভা উপনির্বাচনের আগে। দিন-দুই ছিলাম। বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া করিমপুরে চরমেঘনা তারকাঁটা ভিতরে। সে গ্রামে যেতে হয় বিএসএফের অনুমতি নিয়ে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সেই সব গ্রামের পথে ঘুরে ভোট-ভোট মেজাজটা বড় ধাক্কা খেয়েছিল মাটির একতলার লেপাপোছা উঠোনে। কথা বলে বেরিয়ে আসার সময় গৃহিণী ভাত খেতে বলেছিলেন। অজানা-অচেনা কাউকে এত দরদে এ কথা বলার অভ্যাসে চমকেই গিয়েছিলাম! শস্যসবুজ রূপসী সেই গ্রামের সব কিছু ছাপিয়ে এখনও যা মনে করতে পারি, তা হল— ‘দু’টো গরম ভাত খেয়ে যাও। আর একটুখানি হলেই হয়ে যাবে।’
সেই গরম ভাত ঘুরছে এ শহরের পথে। সকলের জন্য যথেষ্ট নয়। তবু ঘুরছে সেই সব মুখে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy