ফাইল চিত্র।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে অনেক কথাই বলা হয়ে গিয়েছে। লকডাউনও এখন পুরনো। কিন্তু গোটা পরিস্থিতি নিয়ে কয়েকটা ব্যাপারে হয়তো কিছু কথা সোজাসুজি বলার দরকার আছে। সেটাই এই লেখার উদ্দেশ্য। প্রধানত ভারতের পরিপ্রেক্ষিতেই কথাগুলো বলার চেষ্টা করব আমরা।
প্রথম কথা হল, অনেক বড়লোক দেশেই জনসংখ্যায় কমবয়সিদের তুলনায় বয়স্কদের অনুপাত খুব বেশি এবং ক্রমবর্ধমান। বয়স্কদের দেখভাল করতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা সমস্যায় পড়েছে। জন্মহার কমানোর সঙ্গে সঙ্গে আয় বৃদ্ধি, নতুন ধরনের চিকিৎসা ও ওষুধের জন্য মৃত্যুহারও কমেছে। অন্য দিকে, আমাদের মতো দেশে জনসংখ্যায় কমবয়সিদের অনুপাত অনেক বেশি। যেহেতু নোভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপে শারীরিক ভাবে দুর্বল মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাই এটি সম্পন্ন দেশে বয়স্কদের মূল সমস্যা। সংক্রমণের ভয়াবহ ফল এই সব দেশেই বেশি হচ্ছে। প্রাকৃতিক কারণেই মানবদেহ নামক যন্ত্রটি বয়স হলে দুর্বল হয়ে ওঠে। শারীরিক পরিশ্রম করে রোজগার না করতে হলে শরীর আরও ভঙ্গুর হয়। এমন সব রোগ শরীরে বাসা বাঁধে যাতে এমনিতেই মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে যায়। করোনা শুধু প্রক্রিয়াটিকে দ্রুততর করছে।
আর একটা বিষয় আছে। টিভিতে ডাক্তারবাবুরা খুব সুন্দর ভাবে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে এক জন বলেছেন যে এই দেশের মানুষ অনেক ভাইরাস বা জীবাণু এবং রোগের শিকার হয়েছেন যা বড়লোক দেশগুলিতে আজ আর কল্পনাও করা যায় না। ১৯৮১ সালে আমাদের মধ্যে এক জন যখন আমেরিকায় পড়তে গিয়েছিলাম, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে টিবি পজ়িটিভ বা টিবি’র সম্ভাবনা আছে এই রকম একটা কিছু বেরোয়। তাতে কোনও সমস্যা হয়নি। কারণ ভারতে প্রায় সবারই ওই রকম কোনও উপসর্গ থাকে। দিল্লিতে যাঁরা গোটা শীতকাল বসবাস করেন, তাঁরা সবাই এনভায়রনমেন্ট অলিম্পিক্সে-এ সোনার মেডেল পেতে পারেন। অনেকে মজা করে বলবেন, এ দেশের মানুষ কামড়ে দিলে সাপও মরে যাবে। অকল্পনীয় দূষণ, রকমারি রোগভোগে পর্যুদস্ত, চরম সংগ্রামী এই দেশের মানুষ অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেক উন্নত মানের লড়াকু জীব। এখানে এমনিতেই বেঁচে থাকাটা সংগ্রাম। জাতীয় স্বাস্থ্য প্রোফাইল সমীক্ষায় (২০১৮) দেখা যাচ্ছে, দেশে প্রায় ৪ কোটি ১৮ লক্ষ মানুষ প্রবল শ্বাসকষ্টজনিত ব্যাধিতে ভুগেছেন, অর্থাৎ মূলত নিউমোনিয়া ধরনের রোগে। এখান থেকে দিনে এমনিতেই এক লক্ষ মানুষের নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার হিসেবটি স্পষ্ট হয়। যাঁরা ভুগছিলেন, তাঁদের মধ্যে মারা গেছেন চার হাজারের কিছু কম মানুষ।
এই সব কিন্তু ঘটেছে কোভিড-১৯ ছাড়াই। অর্থাৎ আমরা এমনিতেই মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চলেছি। অথচ সেই সংগ্রামের কোনও খবরই রাখি না। গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার ইন্ডিয়া’-তে (অগস্ট ২০০৮) এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, কিলার ইমিউনোগ্লোবিউলিন রিসেপ্টর নামে কিছু উপাদান ভারতের মানুষদের শরীরে অনেক দেশের তুলনায় বেশি। এই উপাদানটি সংক্রমণকে চিহ্নিত ও ধ্বংস করে। অন্য গবেষণা দেখিয়েছে আফ্রিকার মানুষদের এই শক্তি সর্বাধিক, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের মধ্যেও খুব কম নয়। তাই গোষ্ঠী সংক্রমণের চেহারা এই দেশগুলোতে এক রকম না-ই হতে পারে।
এর মানে এই নয় যে আমাদের এই সংক্রমণ নিয়ে বিশেষ কোনও ভয় নেই। ঝুঁকি প্রচুর। প্রথমত, বয়সের বিন্যাস বা রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা যদি বা কিছুটা সুবিধে করে দেয়ও, অন্য দিকে আমাদের অসুবিধেও বিপুল। দারিদ্রের কারণেই অপুষ্টি এবং রোগভোগের মাত্রা অসম্ভব বেশি। আর, ১৩০ কোটির দেশে ১ শতাংশ মানেই সংখ্যাটা ১ কোটির ওপরে। সংক্রমিতের সংখ্যার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সামগ্রিক সমস্যা তাই অনেক বেশি।
এই সমস্যা বহু গুণ বাড়িয়ে তোলে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা। বস্তুত, সারা বিশ্বেই এত সব যুগান্তকারী প্রযুক্তি বিপ্লবের পরে আমরা মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার আর ভেন্টিলেটর প্রয়োজন অনুযায়ী দ্রুত তৈরি করতে পারছি না। আমাদের অবস্থাও তথৈবচ। ডাক্তার, নার্সদের একই মাস্ক একাধিক বার ব্যবহার করতে হচ্ছে! বাজারে নতুন মোবাইল ফোন এলে তার থেকে কী কী বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে, সেই নিয়ে বিজ্ঞাপনের প্রাবল্য এতটাই বেশি হয় যে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়া ভেন্টিলেটরের সংখ্যাও যে এমনিতেই বাড়িয়ে রাখা দরকার সেটা নিয়ে কেউ সরব নন, বিজ্ঞাপন তো অনেক দূরের ব্যাপার। স্বাভাবিক নিয়মে ভেন্টিলেটর (এবং যথাযথ মানের মাস্ক) যদি আজ যথেষ্ট পরিমাণে জোগান দেওয়া যেত, তবে কি পরিস্থিতি এমন হত? দু’একটা ব্যতিক্রমী রাজ্য বাদ দিলে ভারতের পরিস্থিতি খুবই সঙ্গিন। এই দেশে কিছু দিন আগে কর্পোরেট সেক্টরকে হাজার হাজার কোটি টাকা কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। তাঁরাই বা এই সমস্যার সমাধানে কী করছেন?
অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy