মহারাষ্ট্রের দিবা’তে আটকে যাওয়া নুর ইসলাম। ওঁর সঙ্গে আটকে থাকা ৩০০ জনই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার মানুষ। লকডাউনের পর স্থানীয় প্রশাসন বলেছে, অত লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে না। এলাকার স্কুলে খিচুড়ি খাচ্ছেন। পরিমাণ খুব কম। তার পর খাবারের খোঁজে বেরলেই, পুলিশের লাঠি। মমতা জুল লুধিয়ানায় জরির কাজ করতে গিয়েছেন। স্থানীয় লঙ্গরখানায় এক বেলা খেয়ে দিন গুজরান হচ্ছিল। এখন লঙ্গরখানা বন্ধ। খাবারের কথা বললেও পুলিশ লাঠিপেটা করে।
পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া লকডাউন হওয়ায় ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজ, বাসস্থান হারিয়ে আকাশের নীচে দাঁড়িয়েছেন। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। আদালতে গিয়েও অবস্থা বদলায়নি। কায়িক শ্রমজীবীদের নিজেদের পরিবেশ পরিজন ছেড়ে রুটিরুজির সন্ধানে দূরদেশে যেতে হয়। এখনও পশ্চিমবঙ্গের চটকল অঞ্চলে বিহারি লাইন, ওড়িয়া লাইন ইত্যাদি মহল্লায় অন্য প্রদেশ থেকে আসা মানুষের শ্রমের ইতিহাস লেখা। এই সব অঞ্চলে বাংলা ছাড়া অন্য ভাষার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রমাণ করে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি বিসর্জন না দিয়েই তাঁরা সমাজ ও রাষ্ট্রে গৃহীত হয়েছিলেন। এই তথ্য ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিরও প্রমাণ।
কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যান্তরে যাওয়ার সঙ্গে এই ধারাবাহিক ইতিহাসের ঘোর অমিল। অনেকের ধারণা, অসংগঠিত শিল্প যতটা (৯২%) পরিযায়ী শ্রমিক নির্ভর, সংগঠিত শিল্প ততটা নয়। পরিসংখ্যান তা বলে না। মারুতি কারখানায় পরিযায়ী শ্রমিক স্থানীয় শ্রমিকের থেকে কয়েক গুণ বেশি। দেশের শিল্পের চাকা পরিযায়ীর শ্রমেই ঘোরে। ২০১১-র আদমসুমারি অনুযায়ী, পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৪৮.২ কোটি (ভিন্ রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা ৯০ লক্ষ)। ২০১৬-য় তাঁরা ৫০ কোটি। আজ সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে বেড়েছে।
এই বিপুল মানুষকে এমন অবহেলা, ইচ্ছাকৃত হেনস্থার রাজনৈতিক কারণ কী? নাগরিক হিসেবে তাঁদের চলাচলের অধিকারকে পরোক্ষে খর্ব করার ঔদ্ধত্য দেখাবে কেন রাষ্ট্র? ১৯৭৯-এ ‘ইন্টারস্টেট মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কমেন (রেগুলেশন অব এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড কন্ডিশনস অব সার্ভিস) অ্যাক্ট ১৯৭৯’ সংসদে গৃহীত হয়। মজুরি ছাড়াও এই আইনের ১৪ নং ধারা অনুযায়ী, তাঁরা অন্য রাজ্য থেকে কাজে আসেন, তাই স্থানচ্যুতির ভাতা প্রাপ্য। ১৫ নং ধারায়, বাড়ি ফেরার রাহাখরচ এবং কর্মস্থলে বিনামূল্যে বাসযোগ্য বাসস্থান ও স্বাস্থ্য পরিষেবা অবশ্য প্রাপ্য। আইনটি ১৯৭৯-এর। কিন্তু বিশ্বায়নের অর্থনীতির সূচনার পর শিল্পজগতের উৎপাদন, লগ্নির ধরন, বাজারের চরিত্র পরিবর্তিত। সেই সূত্রে আইনটিকে পরিমার্জন, সময়োপযোগী করার খবর নেই। আর, প্রথাগত ট্রেড ইউনিয়ন আইনি সুরক্ষার অধিকার বিষয়ে শ্রমিকদের ‘জানাবার’ দায়িত্ব পালন করেনি।
লগ্নির ক্ষেত্র বদলানোয় পরিযায়ী শ্রমিকের কাজের ধরন বদলেছে। আজ বেঙ্গালুরু, কাল মহারাষ্ট্র, পরশু পঞ্জাব। স্থায়িত্ব, সামাজিক ভাবে গৃহীত হওয়ার সুযোগ নেই। পূর্ব আর উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষই বেশি। উত্তরপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, ছত্তীসগঢ় থেকেও শ্রমজীবীরা অন্য রাজ্যে যান। প্রায় সকলেই দলিত ও মুসলমান। এবং ভূমিহীন।
উন্নয়নশীল দেশে শ্রমের মূল্য কম, তাই কিছু ক্ষেত্রে গরিব দেশের শ্রমিকদের কাজের বাজার হয়েছে। বাংলাদেশে পোশাক তৈরি, ভারতে আইটিকে ঘিরে কর্মসংস্থান হয়েছে। আনুষঙ্গিক শিল্প গড়ে উঠেছে। পরিযায়ী শ্রমিকের চাহিদাও বেড়েছে। পূর্ব ভারত থেকে রাজ্যান্তরীদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গীয়রা খুবই বেশি। কৃষি, নির্মাণ, বস্ত্র, গহনা, স্বাস্থ্য, এমব্রয়ডারি, পরিবহণ, গৃহকর্ম, সাফাই ইত্যাদিতে তাঁরা জড়িত।
এত মানুষ, এত কাজ! কিন্তু রাষ্ট্রীয় তরফে নিরাপত্তা নেতিবাচক। উল্টে, বেঙ্গালুরুর পুলিশ পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিককে বলেছেন, বাংলা বলেন কেন? এক ভারতীয় বাংলাদেশের ভাষা বলবেন কেন? উত্তর না দিতে পারলেই প্রমাণ হবে, তিনি ভারতীয় নন। রাষ্ট্র ভুলে গিয়েছে এঁদের নাগরিক সুবিধা দিতে রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মারণ রোগের সঙ্কটে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভিতরের চিত্রটি একেবারে উলঙ্গ। স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে খাদ্যনিরাপত্তা সবই প্রশ্নের সামনে। তাও পরিযায়ী শ্রমিকের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়তো সব চেয়ে কঠিন বাস্তব।
সন্দেহ হয়, রাষ্ট্রের অনিচ্ছাকৃত অপদার্থতা নয়, এই হেনস্থার মূলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। পরিযায়ী শ্রমিকরা প্রায় সকলেই নিম্ন বর্ণের হিন্দু বা মুসলমান। শাসকদের স্বপ্নের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ভারতে দলিত এবং মুসলমানদের স্থান দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্বে। এই জন্যই কি এঁদের সঙ্গে এমন আচরণ? আজ রাজনৈতিক কারণেই কি প্রশাসন এঁদের অস্তিত্ব অস্বীকারের ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে? কাল এঁদের নাগরিক পঞ্জিকরণের বাইরে ফেলে দেওয়া গেলেই, উদ্দেশ্য সফল। ডিটেনশন ক্যাম্পও লাগবে না।
গণমাধ্যমে পৃথিবী দেখেছে রাজধানীতে কোলে শিশু, কাঁধে ব্যাগ, বৃদ্ধা মা আর স্ত্রী নিয়ে কয়েকশো কিলোমিটার হাঁটতে প্রস্তুত গৃহাভিমুখী মানুষের ঢল। স্বাধীন দেশের নাগরিক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy