আগে ছিল সংক্রমণের ভয়। তার পর যত দিন যাচ্ছে, তত নতুন নতুন ভয় ছায়া ফেলছে মনে। বিপুল জনসংখ্যার মধ্যে সংক্রামক রোগের প্রতিরোধ যেমন কঠিন, তেমনই জটিল কাজ এত কারণে এত মানুষের বিচিত্র উদ্বেগের মোকাবিলা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতির সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ আসলে বাস্তব ক্ষতিকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। দেশ-বিদেশ থেকে খবর আসছে, ভাইরাস পরীক্ষায় পজিটিভ ধরা পড়ার পর, এমনকি সংক্রমণ হয়ে থাকতে পেরে সেই আশঙ্কায়, কিছু কিছু মানুষ আত্মহত্যা করছেন। দীর্ঘ লকডাউনের ফলে আর্থিক পরিস্থিতির কতটা অবনতি হবে, সেই আশঙ্কা থেকে জার্মানির অঙ্গরাজ্য হেস-এর অর্থমন্ত্রী টমাস শেফার আত্মহত্যা করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, দেশে অর্থনৈতিক অবরোধ চললে আত্মহত্যা বাড়তে পারে। সব মিলিয়ে এত দিনে স্পষ্ট যে, মহামারি থেকে ক্ষতি এড়াতে যা কিছু করা দরকার, তার মধ্যে রাখতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যকেও। মন ভাল না থাকলে মানুষ ভাল থাকে না। কী করলে ভয় কমে, উদ্বেগ প্রশমিত হতে পারে?
সব উদ্বেগই মন্দ নয় বা সব ভয় অকারণ নয় যে এখনই তাড়াতে হবে। আজ এত কোটি কোটি মানুষ যে ঘরবন্দির ডাকে সাড়া দিয়েছেন, তার কারণই তো ভয়। রোগের উদ্বেগ কাজ করছে বলেই সরকারের অনুরোধে নাগরিক সাড়া দিয়েছেন, না হলে এত লোককে দিনের পর দিন জোর করে ঘরে আটকে রাখা অসম্ভব হত। যে উদ্বেগের মূলে যথেষ্ট কারণ আছে, যা নিরাপদ থাকার উপায় সন্ধান করতে মানুষকে প্রণোদিত করে, তা ক্ষতিকর নয়। তবে যদি দেখা যায়, রোগের ভয়, বা অন্য কোনও কিছু নিয়ে উদ্বেগ এত তীব্র হয়ে উঠছে যে তা কোনও ব্যক্তির দৈনন্দিন কাজের ক্ষমতাকে ব্যাহত করছে, অন্যদের সঙ্গে তার ব্যবহার বদলে যাচ্ছে, আদান-প্রদানে সংঘাত তৈরি করছে, তা হলে তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের নজরে আনতে হবে।
লকডাউনের সময়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ পাওয়ার সুবিধের জন্য কয়েকটা হেল্পলাইন চালু করা হয়েছে। তেমন একটির সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে রোজ বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে ফোনে কথা হয়, যাঁরা উদ্বেগে ভুগছেন। এখনও অবধি আমার অভিজ্ঞতা এই যে, যাঁরা ইতিমধ্যেই উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন, হয়তো তার চিকিৎসাও করাচ্ছিলেন, তাঁরাই বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। দীর্ঘ দিন লকডাউনের জন্য তাঁদের আগের উপসর্গগুলি ফিরছে, অথবা নতুন কোনও উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। তার কারণ হতে পারে চিকিৎসা বা ওষুধের অভাব। দেশের অন্যান্য জায়গা থেকেও খবর আসছে, নিয়মিত ওষুধ কিনতে না পারা, এক সঙ্গে এক মাসের ওষুধ না পাওয়া, কাউন্সেলার বা মনের চিকিৎসকের কাছে যেতে না পারা, এগুলোর ফলে বহু রোগী বিপন্ন হচ্ছেন।
কিন্তু ভারতে এখনও অবধি যা ঘটেছে, তাতে রোগে আক্রান্ত হওয়ার চাইতেও, দীর্ঘ লকডাউনের ফল কী হবে, সেটা মানুষকে ভাবাচ্ছে বেশি। এটা অকারণ উদ্বেগ নয়, এবং মনের চিকিৎসা করা এ থেকে বাঁচার উপায়, এমনও নয়। যাঁরা লকডাউনের ফলে কর্মহীন, সেই দরিদ্র মানুষের সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে, তাই তাঁদের জন্য সরকার যে আর্থিক প্যাকেজ তৈরি করেছে, তাঁদের কাছে সে বিষয়ে প্রচার প্রয়োজন। যাঁরা কাজ হারিয়ে ঘরে ফিরছেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো এখনও জানেন না তাঁরা কী পেতে পারেন, বা অনুদানগুলো পাওয়ার উপায় কী। তাঁদের উদ্বেগ দূর করার উপায়, তাঁদের চাহিদা বুঝে সহায়তার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা তাঁদের জানানো।
দরিদ্র সরকারি সহায়তায় অভ্যস্ত, তাই তার দাবি জানাতেও অভ্যস্ত। কিন্তু জনসংখ্যার একটি বড় অংশ, যারা ছোটখাট পণ্য উৎপাদন করেন, বা ফিরি করেন, বা বেচা-কেনা করেন, বাজার বন্ধ থাকলে তাঁরা অসহায়। এখনই হয়তো তাঁদের অনাহারের দশা নয়। কিন্তু পুঁজি ফুরোলে তাঁরা নতুন করে ঋণ পাবেন কি না, জানা নেই। মহাজন টাকা দিতে রাজি হবে কি না, বিক্রি করার জন্য ধারে জিনিস কিনতে পারবেন কি না, আদৌ কবে আবার ক্রেতা ফিরে পাবেন, তাঁরা জানেন না। এই অনিশ্চয়তা মনের মধ্যে এক রকম উদ্বেগ তৈরি করে।
সঙ্কটের কল্পনায় উদ্বেগ খারাপ নয়। পরীক্ষা নিয়ে ভয় থাকে বলেই ছাত্রেরা পড়াশোনা করে, রোজগারের অনিশ্চয়তার কথা ভেবেই সঞ্চয়, বা অধিক আয়ের চেষ্টা করে মানুষ। সমস্যা তখনই হয় যখন উদ্বেগ এত তীব্র হয় যে তা স্বাভাবিক কর্মক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। প্রতিকূলতার সামনে সকলকেই দাঁড়াতে হয়। ফসল মার খেলে চাষি বিপদগ্রস্ত হন, কারখানা উঠে গেলে শ্রমিক বিপন্ন হন, প্রশ্ন কঠিন হলে ছাত্র বিপাকে পড়ে। কিন্তু যাঁদের উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তাঁরা বিশেষ ভাবে আক্রান্ত হন, ছিটকে যান। এই সব মানুষ সাধারণত তাঁরাই, যাঁরা আগে থেকেই বেসামাল হয়ে রয়েছেন। তাই কারণ যেমন বাইরে, তেমনই ভিতরেও।
আর এক কারণে মানসিক চাপ, অবসাদ দেখা দেয়। তা হল, অভ্যস্ত জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত হওয়া। এক একটা দিন অফুরন্ত অবসর নিয়ে যেন গিলে খেতে আসছে। অনেকের কাছে রোজগারহীনতার মতোই কষ্টকর, সামাজিক মেলামেশার অভাব। দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা আমাদের সামাজিক জীবনের একটা বড় অংশ। চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে বাস স্টপে গুলতানি, সবই বন্ধ হয়ে গেলে একটা অবসাদ পেয়ে বসতে চায়। সমাজমাধ্যম খানিকটা বিচ্ছিন্নতা ঘোচাতে পারে, কিন্তু তা যে যথেষ্ট নয়, সে-ও টের পাওয়া যাচ্ছে।
এ সময়ে পরিবারের মানুষ একে অন্যের প্রতি ধৈর্যশীল, সহানুভূতিশীল হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কাছের মানুষের যে কথাগুলো “অকারণ বাজে-বকা” বলে মনে হয়, সেগুলোও শুনতে হবে, ভরসা জোগাতে হবে। পুরনো রাগ-অভিমান নতুন করে তোলাপড়া করার সময় এ নয়। যাঁরা একাকিত্বে ভুগছেন, ফোনে কথা বলে তাঁদের সঙ্গ দিতে হবে।
তার পরও কিছু মানুষের ক্ষেত্রে সমস্যা তীব্র হবে। তখন চিকিৎসা ছাড়া গতি নেই। মুশকিল হল, করোনাভাইরাসের চিকিৎসা ছাড়া আর প্রায় সব চিকিৎসা এখন “না-জরুরি” বলে চিহ্নিত হয়েছে। মনোরোগের চিকিৎসা তার মধ্যেই পড়বে। এই অভূতপূর্ব সঙ্কটের পরিস্থিতিতে কত মানুষের কাছে সময়মতো মনোরোগের চিকিৎসা “প্রাণদায়ী” চিকিৎসা হয়ে উঠতে পারে, আগাম বলা সম্ভব নয়।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy