ভারতে তিন সপ্তাহের লকডাউনের শেষ সপ্তাহ শুরু হইয়াছে। পরবর্তী অধ্যায়ে জনজীবন নিয়ন্ত্রণের কী ব্যবস্থাপত্র নির্ধারিত হইবে, তাহা এখনও জানা যায় নাই। তবে কিছু সঙ্কেত ইতিমধ্যে মিলিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী ইঙ্গিত করিয়াছেন, ঘরবন্দি দশা হইতে মুক্তির প্রক্রিয়া স্তরে স্তরে অগ্রসর হইবে, সংক্রমণের প্রসার এবং তীব্রতা অনুযায়ী বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণের মাত্রা বিভিন্ন হইবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও রাজ্য সরকারি প্রস্তুতির হিসাবনিকাশ দিয়া জনসাধারণকে আপাতত যথাসম্ভব সংযত জীবনযাপনের বিচক্ষণ সুপরামর্শ দিয়াছেন। সব মিলাইয়া একটি সত্য সুস্পষ্ট। একুশ দিনের মেয়াদ ফুরাইলে ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় ঘোষিত লকডাউন যদি আগামী সপ্তাহে শেষ হয়ও, ‘স্বাভাবিক’ জীবনযাত্রায় ফিরিয়া যাইবার কোনও সম্ভাবনা আপাতত নাই। থাকিবার কথাও নহে। গোটা দুনিয়া জুড়িয়াই এখন বলা হইতেছে: এত দিন সব কিছু যে ভাবে চলিয়াছে, আর সে ভাবে চলিবে না। কথাটির নানা মাত্রা আছে। অর্থনৈতিক কাঠামো, রাজনৈতিক প্রশাসন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সমস্ত ক্ষেত্রেই বড় রকমের পরিবর্তনের প্রয়োজন হইবে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ নানা পরিবর্তন আবশ্যক। যেমন, প্রথমত, আপাতত মানুষকে মানুষ হইতে কিছুটা দূরে থাকিতে হইবে, বিশেষত নাগরিক জীবনে। কেবল সিনেমা, থিয়েটার, ময়দানি খেলা ইত্যাদি নহে, স্কুলকলেজের পঠনপাঠন হইতে শুরু করিয়া অগণিত পরিসরে সামাজিক জীবনে বহু পরিবর্তন মানিয়া লইতে হইবে, মোকাবিলা করিতে হইবে বিস্তর সমস্যারও। অনেক ক্ষেত্রে, যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা গণ পরিবহনে কত দিনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিবে, তাহা অনিশ্চিত। জোর করিয়া এই সব পরিষেবা ‘চালু’ করিয়া দিলে পরিণাম আরও ভয়ঙ্কর হইতে পারে।
দ্বিতীয়ত, এই ধরনের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য অতঃপর অনেক বেশি প্রস্তুত থাকিবার প্রয়োজন হইবে। মুখাবরণ, আরক্ষা-পোশাক, অন্যান্য সরঞ্জাম, চিকিৎসা বা শুশ্রূষার বিভিন্ন ঔষধ, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি প্রকরণ, প্রয়োজনে সংক্রমিত বা সংক্রমণের সম্ভাবনাগ্রস্ত মানুষকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিভৃতে রাখিবার ব্যবস্থা— এই সবই যথাস্থানে মজুত এবং ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত না রাখিলে চলিবে না। বিশেষ করিয়া এই অভিজ্ঞতার পরেও যদি চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনের বিষয়ে, তাঁহাদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রশাসন ও সমাজ তাহার সমস্ত শক্তি ও সদিচ্ছা সহকারে মনোযোগ না করে, তবে বুঝিতে হইবে, আমরা সম্পূর্ণ অপদার্থ। ইহা কথার কথা নহে। দেখিয়া শেখা তো দূরস্থান, ঠেকিয়া শিখিবার রেকর্ডও আমাদের ভাল নহে!
তৃতীয়ত, নিজের উপর এবং অন্যদের উপর সতর্ক নজরদারি না বাড়াইয়া কোনও উপায় নেই। নজরদারি শব্দটি প্রয়োগবৈগুণ্যে নিন্দার্থ পরিগ্রহ করিয়াছে, কিন্তু নির্মম চৌকিদারের নজর আর সহৃদয় শুভার্থীর নজর এক নহে। প্রথমটি পরিহার্য, কিন্তু দ্বিতীয়টি আবশ্যক। পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের ও দুনিয়ার নানা স্থানে সেই পারস্পরিক তদারকি ও সহযোগিতার অগণিত নমুনা প্রতিনিয়ত তৈয়ারি হইয়া চলিয়াছে, মানুষ মানুষের খেয়াল রাখিতেছেন, প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াইতেছেন, দূরত্ব বজায় রাখিয়াই একে অন্যকে সাহায্য করিতেছেন। অনেক অনাচার, অনেক বিশৃঙ্খলা, অনেক নির্বোধ আচরণের ভিড়ে সেই সব সুলক্ষণ হয়তো ঢাকা পড়িয়া যাইতেছে, কিন্তু সেগুলিই আমাদের ভরসা। বড় ভরসা। সম্মুখে দীর্ঘ লড়াই। সংক্রমণ প্রতিরোধের লড়াই। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার লড়াই। বিপন্ন মানুষের পাশে থাকিবার লড়াই। ইহাকে সামরিক যুদ্ধের সহিত একাকার করিলে মস্ত ভুল হইবে। এই ‘যুদ্ধ’ সহৃদয়তার, সুচিন্তার, সদ্বুদ্ধির। ইহাই প্রকৃত ধর্মযুদ্ধ। মানবধর্ম প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy