আগের পর্বে (‘সুবিধে আছে, ঝুঁকিও কম নয়’, ১৩-৫) কোভিড-১৯ সংক্রমণের কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। এ বার আসি করোনা মোকাবিলার প্রসঙ্গে। আমাদের দেশে অনেক আগেই লকডাউন ঘোষণা করা উচিত ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) যখন সাবধান বাণী শুনিয়েছিল, তখনই এই দেশের সমস্ত বিমান যাত্রা বন্ধ করা উচিত ছিল। করা হয়নি। আবার, কেন্দ্রের প্রায় দু’লক্ষ কোটি টাকার যে অনুদান ঘোষিত হয়েছে, তাতে একটু আগে থেকে পরিকল্পনা করে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি খাবারের প্যাকেট পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারলে লকডাউন প্রক্রিয়াকে এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে হত না। অসংগঠিত শ্রমিকদের থাকার জায়গা ছিল, কিন্তু তাঁরা খেতেন কী? এটাই ছিল মূল সমস্যা। এই রাজ্যে শুরু থেকেই অন্তত সেটার দিকে কিছুটা নজর দেওয়া হয়েছে।
লকডাউন করে নিশ্চয়ই জনসাধারণের উপকার হয়েছে। যদিও চিন যে ভাবে নির্দিষ্ট এলাকায় সম্পূর্ণ লকডাউন বজায় রেখে করোনার মোকাবিলা করতে পেরেছে, সেটা এ দেশে কঠিন। কিন্তু চিন যা করে দেখাতে পারল, সেটা আমরা কেন পারছি না— এই কান্না অর্থহীন। অমর্ত্য সেন অনেক দিন আগে এক অসাধারণ তত্ত্বের কথা বলেছিলেন, যার সারমর্ম কিছুটা এই রকম যে ভারতের মতো গণতান্ত্রিক, মিডিয়া-সমৃদ্ধ দেশে বড় রকমের দুর্ভিক্ষের খবর লুকোনো শক্ত, কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে অপুষ্টিজনিত সমস্যা বিরোধী রাজনৈতিক দল বা মিডিয়ার চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। এখনই অনেক মৃত্যু না হলে সেটা খবর হয় না। চিনে ঠিক উল্টো। স্বৈরতান্ত্রিক দেশে সরকার কড়া কড়া নীতি নিলে দারিদ্র ও অপুষ্টির সুরাহা খানিকটা হতে পারে, কিন্তু বড়সড় দুর্ভিক্ষের কথা সরকার গোপন করতে পারে। কোভিড সমস্যায় যে তেমনটা হয়নি, সেটা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারছেন না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, যার হাত ধরে সংবাদমাধ্যম ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখে, তার সুফল আমরা এত ভাবে পাই যে সেটা আমাদের খেয়াল থাকে না।
খেপে খেপে বেশ কয়েক বার লকডাউন চলছে দেশে, কিছু কিছু জায়গা একটু একটু করে ছাড় পাচ্ছে। এর মূল কারণ অর্থনৈতিক। বাজার এত দিন স্তব্ধ থাকলে রুজি রোজগারের সঙ্কট দেখা দেয়। কিন্তু লকডাউন ছাড়া কোনও উপায় ছিল না, এখনও নেই। অনেকেই এটাকে পাত্তা দিচ্ছেন না এবং পুলিশের ওপরে চড়াও হচ্ছেন। এঁরা অনেকেই হয়তো উচ্চশিক্ষিত নন। কিন্তু উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেও কেউ কেউ মুখোশ পরলে ‘খারাপ’ লাগে বলে সেটি পরছেন না। আসলে মানুষ কত স্বার্থপর হয়, সেটাও কোভিড-১৯ দেখিয়ে দিচ্ছে। সব সরকারই অল্পবিস্তর চেষ্টা করছে, তাই লকডাউন অনেকটাই সফল হচ্ছে। তা না হলে আমাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন, অমানবিক কাজ করতে এক মুহূর্ত সময় লাগত না। এই দেশটায় গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হল, যেখানে যে কোনও আইন ভাঙা যায়। বিশেষ করে বিবদমান রাজনৈতিক শক্তিকে নির্বাচনের ভয় দেখিয়ে পণবন্দি করে রাখা যায়।
তবে একটি বিষয়ে খটকা লাগে। এখনও পর্যন্ত কোনও বিস্তারিত সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্ট্র্যাটেজি দেখতে পাইনি। এই দুর্ঘটনার অর্থনৈতিক কুফল অত্যন্ত দক্ষ আর্থিক নীতি প্রণয়নের পরেও বেশ কয়েকটা বছর আমাদের ভুগতে হতে পারে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের রাস্তা এখনই কেন খুলে দেওয়া হল, সেটা বোঝা গেল না। সামগ্রিক ভাবে, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণে যুক্তরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা আর সমন্বয়ের ভিতটা আরও অনেক বেশি মজবুত হওয়া দরকার। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। কোনও জেলা বা এলাকাকে রেড জ়োন ঘোষণা করা মানে সেখানে কোনও ধরনের অর্থনৈতিক কাজকর্ম হবে না। যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকার এটা ঘোষণা করবে এবং রাজ্যগুলো সেই মতো কাজ করবে, ফলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত রেড জ়োন ঘোষণা এক অর্থে রাজ্য সরকারগুলোকে বিপদে ফেলবে। এটা কোনও রাজনীতি করার জায়গা নয়। অন্য দিকে, সব রাজ্যে কোভিডের ফলে কত আক্রান্ত, কত লোকের মৃত্যু হচ্ছে এ সব বিষয়ে ঠিক ঠিক তথ্য নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয়, তা নিয়ে রাজনীতিও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু দশমিকের ঘর অবধি ঠিক তথ্য দিলেই মানুষ ঘরে সেঁধিয়ে যাবে এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই। কোভিড-১৯’এর বিশ্বজোড়া ভয়ঙ্কর মারাত্মক খবরের পরেও মুখোশ পরতে হবে বলে মানুষ পুলিশ আর স্বাস্থ্যকর্মীদের হেনস্থা করছে! আর, দয়া করে দেশের দুরবস্থার জন্য কোনও বিশেষ সম্প্রদায়কে দায়ী করবেন না।
শেষে বলি, ইতিহাসের পথ ধরে এগোতে শুরু করলে দেখা যাবে যে শত শত জানা-অজানা রোগভোগ এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে লড়ে ঘর করা কোটি কোটি মানুষ এ-যাবৎ নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছেন। অতএব আশা করাই যায় যে, বিভিন্ন পর্যায়ে গৃহীত প্রশংসনীয় সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি চেনা-পরিচিত পরিকল্পনাজনিত সমস্যা থাকলেও তাঁরা ঠিকই টিকে থাকবেন। (শেষ)
অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy