সুরক্ষার ব্যবস্থা জরুরি ছিল
কাশ্মীরের কোনও গ্রামে থাকেন তিনি। তিনি না আসা মানে শীত অপূর্ণ থেকে যাওয়া। প্রতি বছর নানা রঙের শাল নিয়ে হাজির হন তিনি। জানি না এই সময়ে তিনি কি করছেন? সে দিন দেখলাম পাশের গ্রামের এক পরিচিত বৃদ্ধকে। ছেলে ভিন্ রাজ্যে কাজ করেন। দেখা হতেই হেসে কথা বললেন। তবে তাঁর চোখমুখ ফুটে বের হচ্ছিল উৎকণ্ঠা। কাঁপা কাঁপা গলায় বৃদ্ধ বললেন, “কী জানি কবে যে ছেলেটা ফিরবে? ও ফিরলে ওকে খাওয়াবো কী? রেশন থেকে আর স্বেচ্ছাসেবীদের দেওয়া যেটুকু জিনিস মিলছে তাতে তো আমাদের সবারই সারা মাস চলছে না।’’ গোটা রাজ্য জুড়ে খোঁজ নিলে দেখা যাবে এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁদের প্রিয়জন কাজ করতে ভিন্ রাজ্যে গিয়েছেন। লকডাউনের পরে বদলে গিয়েছে তাঁদের প্রাত্যহিক জীবনের চেনা ছবিটা।
সে দিন স্টেশনের কাছে দেখা হল আরও এক পরিচিতের সঙ্গে। তাঁর ছেলে ভিন্ রাজ্যে গিয়েছেন কাজের খোঁজে। কাজ জুটেও ছিল। মহারাষ্ট্রের একটি কারখানায়। লকডাউন শুরু হওয়ার পরে ফিরতে পারেননি। আচমকা ঘরে ফেরার সুযোগ এসেছে কেন্দ্রীয় সরকার ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায়। কিন্তু সঙ্গে যত টাকা ছিল তা এই কয়েক মাসেই খরচ হয়ে গিয়েছে। ফলে ঘরের জন্য টাকা আনা তো দূর অস্ত্, ঘরে ফেরার জন্য পরিবারের শরণাপন্ন হতে হয়েছে তাঁকে। ছেলের আকুতি শুনে সম্বল বলতে যা টাকা ছিল, তা নিয়েই কোথায় টিকিট কাটা যায় তা খুঁজতে বেড়িয়েছেন বৃদ্ধ। কিন্তু ছেলের অ্যাকাউন্টে কী ভাবে টাকা দেবেন তাঁর খোঁজে হন্যে হয়ে এলাকা তোলপাড় করছেন। উৎকণ্ঠিত চোখে মুখে একরাশ উৎকণ্ঠা, আর সহজ সরল প্রশ্ন, ‘‘খেতে তো দেয়নি। ফেরার টাকাটাও আমাদেরই দিতে হবে?’’ ঠিক এই প্রশ্নটাই করছেন অনেকে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে লকডাউনের গোড়া থেকে সরব হয়েছেন অনেকে। কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারগুলির কাছে বারবার পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ব্যবস্থা করতে অনুরোধ জানিয়েছেন অনেকে। রাজ্যগুলি নিজেদের মতো করে কিছু পরিকল্পনা করলেও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণের আর্জি জানাচ্ছেন অনেকে। তাঁদের দাবি, অধিকাংশ পরিযায়ী শ্রমিক অসংগঠিত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের অনেকেরই না আছে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ন্যূনতম সুবিধা, না আছে পরবর্তী জীবনের জন্য কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। এঁদের ‘ইএসআই’, ‘পিএফ’-এ অন্তর্ভুক্ত কী ভাবে করা যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা করার আর্জি বারেবারেই জানানো হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই সরকারের তরফে বিশেষ উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বর্তমান পরিস্থিতি অন্তত এটুকু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য দেশজুড়ে পরিকল্পনা করার প্রয়োজন রয়েছে। নজর দেওয়া প্রয়োজন তাঁদের স্বাস্থ্য, আর্থিক সুরক্ষার মতো বিষয়েও। যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা ঘরে ফিরছেন, তাঁদের ঠিকমতো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি ইএসআই-এর মতো কোনও স্বাস্থ্য পরিকল্পনায় এদের অন্তর্ভুক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেত তা হলে কিন্তু রোগের বিস্তার আটকানোয় আমরা এগোতে পারতাম। বিষয়গুলি গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
রাতুল মুখোপাধ্যায়
জিওলজি, দ্বিতীয় বর্ষ, দুর্গাপুর সরকারি মহাবিদ্যালয়
ঠিক পরিকল্পনা করা দরকার
রেললাইনে শুয়ে থাকা শ্রমিকদের উপর দিয়ে ট্রেন চলে যাওয়ার ঘটনায় তোলপাড় গোটা দেশজুড়ে। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ট্রেন চালু হতেও দেখা দিল নানা ধরনের সমস্যা। ট্রেনের ভাড়া কারা দেবে তা নিয়ে নানা টানাপড়েন। সেই ট্রেনের টিকিট জোগাড় করতে গিয়েও নাকাল হচ্ছেন ভিন্ রাজ্যে বসবাসকারী শ্রমিকেরা। তাঁদের অনেকেই কম্পিউটার তো দূর, স্মার্টফোন ঠিকভাবে চালাতেও দক্ষ নন। তাঁদেরকেই বলা হয়েছে অনলাইনে টিকিট কাটতে। সমালোচকেরা বলছেন, এতে কালোবাজারি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে সব ভ্রুকূটি উপেক্ষা করেই ঘরে ফিরেছেন তাঁরা। কিন্তু ফেরার পরেও নতুন সমস্যা। এক দিকে, তাঁদের ঠিকমতো স্বাস্থ্য পরীক্ষা না হওয়ায় অভিযোগ উঠছে, অন্য দিকে, কী ভাবে এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিককে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে পরিবার-সহ কোয়রান্টিনে রাখা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বেশ কয়েকটি রাজ্য প্রশাসনের দাবি, এই অবস্থায় এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য সরকারি কোয়রান্টিনের ব্যবস্থা করা কঠিন। ফলে তাদের হোম কোয়রান্টিন রাখার পক্ষে বেশ কয়েকটি রাজ্যের প্রশাসন। তাতেও নানা প্রশ্নচিহ্ন থাকছে।
বস্তুত লকডাউনের পরে পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। সমালোচকদের অনেকে বলছেন, এর মূলে রয়েছে পরিকল্পনার অভাব। অসংগঠিত ক্ষেত্র বিপুল কর্মসংস্থানের জায়গা হলেও এই অংশটি নিয়ে বরাবরই পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। ফলে, এই দুর্যোগের সময়ে তাঁদের সমস্যা কার্যত সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। পথে আমরা পরিযায়ীদের বিপুল স্রোত দেখেছি। প্রবল কষ্টের মধ্যে ঘরে ফিরলেও সেখানেও এঁদের জন্য সুখের দিন অপেক্ষা করছে না। ঠিকমতো স্বাস্থ্যপরীক্ষা না হওয়ায় এঁদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আরও আশঙ্কার কথা এই যে, করোনা আক্রান্ত উপসর্গহীন ব্যক্তির সংখ্যাই বেশি। ফলে শুধু মাত্র উপযুক্ত সরকারি পরিকল্পনার অভাবে এই অসুখ গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
আবার কোন বাড়ির কত জন সদস্য কাজের জন্য ভিন্ রাজ্যে গিয়েছেন বা ভিন্ দেশে যাচ্ছেন তার কোনও সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান রাজ্য বা কেন্দ্র— কারও কাছেই নেই। গবেষকেরা বলছেন, অনেক আগেই যদি বিদেশ ফেরত মানুষজনের উপরে নজরদারি করে তাঁদের কোয়রান্টিনে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেত তা হলে এই অসুখ ভারতে শাখা বিস্তার করার সুযোগই পেত না। সত্যি তা হত কি না সে নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, কিন্তু তখন আমরা এই নজরদারির বদলে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ ও ‘কমলবধ পালা’ দেখতে মত্ত ছিলাম। ফলে গোড়াতেই গলদ থেকে যায়।
আগামিদিনে এই পরিস্থিতি কেটে গিয়ে নতুন সূর্য উঠবে, এমন আপ্তবাক্য না আওড়ানোই ভাল। গবেষকেরা বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কাজ হারাতে পারেন অনেকেই। সে ক্ষেত্রে কোপ পড়তে চলেছে অভিবাসনের উপরেও। পরিযায়ী শ্রমিকেরাও যে এলাকা ছেড়ে এসেছেন সেখানে কবে ফিরে গিয়ে কাজ পাবেন সে নিয়েও কোনও নিশ্চয়তা নেই। পরবর্তী সময় এঁরা যাতে ভাল ভাবে বাঁচতে পারেন এবং ভবিষ্যতে যাতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায় সে জন্য এখন থেকে নজর দেওয়া দরকার। শুধু চাল বা টাকা দিলেই রাষ্ট্রের দায় শেষ হয়ে যায় না, তার সঙ্গে সঙ্গে দরকার, সামাজিক সুরক্ষা যোজনাও। করোনা পরিস্থিতি এটুকু অন্তত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়ে দিয়ে গেল।
সূর্য গঙ্গোপাধ্যায়
জিওলজি, দ্বিতীয় বর্ষ, দুর্গাপুর সরকারি মহাবিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy