Advertisement
১৯ জানুয়ারি ২০২৫
Coronavirus

একেই বলে নৃশংসতা

অতিমারির এই সব দিনরাত আমরা লকডাউনের মধ্যে থেকে অতিবাহিত করছি হাজার অভিযোগ নিয়ে। আমাদের পাতে একঘেয়ে খাবার; রেস্তোরাঁ, এমনকি ঘরে খাবার পৌঁছে দেবার অ্যাপগুলিও বন্ধ।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

তাজুদ্দিন আহ্মেদ
শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২০ ০১:০৩
Share: Save:

মহাভারতের শান্তি পর্বের অন্তর্গত আপদ্ধর্ম পর্বে যুধিষ্ঠির যখন ভীষ্মকে নৃশংস মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, ভীষ্ম নরহত্যা, গলা কাটা, তির মারা বা চাবুক মারার মত কোন কিছুর উল্লেখ না করে বলেছিলেন, “যে উত্তম ভোজ্য, পেয়, লেহ্য আরও দামি দামি ভোগ্যদ্রব্য (না খেয়ে) চেয়ে থাকা মানুষদের মধ্যে বসে উপভোগ করে খায়, তাকেই ‘নৃশংস’ বলা উচিত।” ভীষ্ম বর্ণিত এই নৃশংসতা, আমাদের দেশে, আক্ষরিক এবং রূপকার্থে, একটি সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বেশ কয়েক দশক জুড়ে, বিশেষত নয়া অর্থনীতির হাত ধরে ভোগবাদ এখানে মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসার পর থেকেই। ফলে, অনাথ আশ্রমের জমিতে দেশের সবচেয়ে ধনী শিল্পপতি নিজের পরিবারের গুটিকয় সদস্যের থাকার জন্য অনায়াসে ২৭ তলা বিলাসবহুল প্রাসাদ তৈরি করেন; নোটবন্দির দুঃসহ সময়ে রাজনৈতিক নেতা তথা ধনকুবের অক্লেশে নিজের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে ৩৬ একর জমির ওপর মধ্যযুগের হাম্পি শহরের প্রতিরূপ নির্মাণ করেন। এই রকম অজস্র উদাহরণ প্রতি মুহূর্তে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠছে। নৃশংসতার এই সংস্কৃতি আরও এক বার বেআব্রু হয়ে হাজির হল অতিমারির দুঃসময়ে।

অতিমারির এই সব দিনরাত আমরা লকডাউনের মধ্যে থেকে অতিবাহিত করছি হাজার অভিযোগ নিয়ে। আমাদের পাতে একঘেয়ে খাবার; রেস্তোরাঁ, এমনকি ঘরে খাবার পৌঁছে দেবার অ্যাপগুলিও বন্ধ। সিনেমা হল, শপিং মল খোলা না থাকায় বিনোদনের জন্য আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে হটস্টার, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন অথবা অন্য স্ট্রিমিং প্লাটফর্মের মধ্যে কোনটি দেখা যায় সেই কঠিন সমস্যা নিয়ে। পাড়ার বাজারে থলি এবং অনেকগুলো টাকা ছুঁড়ে দিয়ে সব বেশি বেশি করে কিনে রেখেছি কিন্তু জ্যান্ত ট্যাংরা মাছ আর আরব দেশ থেকে আমদানি করা খেজুর পাওয়া গেল না বলে আপসোস আমাদের থেকেই যাচ্ছে। সিঙ্গল মল্টের সঞ্চয় শেষ, তাই সাধারণ পানীয়ের দিকে হাত বাড়াতে হচ্ছে বলে হা-হুতাশ করছি। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটগুলোতে আমরা নতুন নতুন রান্নার প্রদর্শন করছি অথবা নতুন রকমের পোশাক পরার চ্যালেঞ্জ পরস্পরের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছি। যে সন্তান সন্ততিদের অনেক অর্থ ব্যয় করে আমরা অন্য রাজ্যে পড়তে পাঠিয়েছি, সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাদের ফেরত আনা হবে এই আশা রাখি, দেশের বেশ কিছু রাজ্য সম্পন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েদের ফেরত আনাকে সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য বলে বিবেচনা করেছে।

অথচ এর মধ্যে মূর্তিমান অস্বস্তির মতো হাজির, পরিযায়ী শ্রমিকের দল। রাষ্ট্র এই সব হতদরিদ্র মানুষগুলিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবে না জেনে তারা নিজেরাই ছিন্নমূল স্রোতের মত পথে নেমেছে। তাদের কেউ কেউ হাজার মাইল পথ হেঁটে গ্রামের বাড়ি পৌঁছেছে; কাউকে বা পথিমধ্যে আটকে সরকারি শিবিরে রাখা হয়েছে; কেউ বা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ১৫০ কিলোমিটার পার হয়ে এসে শেষে নিজের গ্রামের কাছে পৌঁছে মারা গেছে। এই সব শ্রমিক ছাড়াও রয়েছে বহু কোটি দিন আনি দিন খাই মানুষ। এদের সঞ্চয় কোনও দিনই তেমন থাকে না। আজ তাদের নুন ও পান্তা দুই-ই ফুরিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মাত্র তারা ব্যাঙ্কে ছোটে বরাদ্দ পাঁচশো টাকা হাতে পেতে; মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ জানা মাত্রই রেশন দোকানে ভিড় করে বিনা পয়সায় চাল, আটা পেতে। এদের জঠরের আগুনের কাছে সংক্রমণে মৃত্যুর ভয় হার মেনেছে। অসহায় ক্রোধ কোথাও কোথাও জ্বলে উঠেছে— সুরাতে, দিল্লির ত্রাণশিবিরে, বান্দ্রার রেল স্টেশনে। এই অর্বাচীনতায় আমরা বিরক্ত হয়েছি। শার্ল বোদলেয়ারের গল্প ‘আইজ় অব দ্য পুয়োর’ মনে পড়ে, যেখানে কথক ও তার প্রেয়সীর মত যাদের পানভোজনের দৃশ্য রেস্তোরার বাইরে থেকে নির্নিমেষ নয়নে দেখছিল অভুক্ত, রুগ্ন পিতা ও তার দুই সন্তান।

কিন্তু বিরক্ত হওয়া কি সত্যি আমাদের শোভা পায়? ভীষ্ম কথিত ‘নৃশংসতা’ যদি আমাদের চরিত্রের অঙ্গ বলে মেনে নিই তাহলে এই অশালীন বৈষম্যের মধ্যেই আমরা সুষমা খুঁজে পাব এবং এই বিরক্তি হবে আমাদের শোভন আভরণ। কিন্তু কণামাত্র যদি সংশয় থাকে, তবে হৃদয় খুঁড়ে আমাদের সন্ধান করতে হবে মহাভারত বিবৃত ‘অনুক্রোশ’ নামক অনুভূতি যার বলে উৎপীড়িত, যন্ত্রণার্ত, দুঃখী কাউকে দেখলে সমবেদনা জেগে ওঠে। সেই অনুভূতি আমাদের সংবেদনশীল করে তুলতে পারে। আমরা তখন আমাদের সুপক্ক পলান্নে নিরন্ন চাষির দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাব, বাসগৃহের শ্বেতশুভ্র মর্মরে কর্মহীন নির্মাণ কর্মীর চোখের জলের দাগ দেখতে পাব। এই সব ঋণের খতিয়ান স্মরণে থাকলে ক্লান্ত এই মানুষগুলি যারা দুটি অন্নের নিমিত্ত সার দিয়ে প্রতীক্ষা করছে, সামান্য অর্থের আশায় হাত পাতছে বিদেশ বিভুঁইয়ে অচেনা লোকের কাছে, নিজ গৃহের সন্ধানে বেরিয়ে বিতাড়িত হচ্ছে প্রতি পদে, তাদের সব অপমান, সব ব্যথা আমাদের নিজের অপমান, নিজের ব্যথা বলে মনে হবে। ভাগ করে নেওয়া অপমানেই আমরা হয়ে উঠব, “তাহাদের সবার সমান”; সম্ভব হবে নিম্নে নেমে এসে আর্ত, দুঃখীর হাত ধরা।

এমন নয় যে আমাদের মধ্যে কেউই সে কাজ করছেন না। লকডাউনের এই কঠিন সময়ে দুঃখীর দুঃখ দূর করতে, নিরন্নের অন্নের ব্যবস্থা করতে আমাদেরই অনেকে অর্থ এবং শ্রম দিয়ে চলেছেন দেশের নানা প্রান্তে। কিন্তু এখনও তাঁরা নিতান্তই ব্যতিক্রম। আজ যখন ‘মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে’, ‘অভিশাপ আঁকি’ দিয়েছে ‘জাতির অহংকারে’, তখনও ব্যতিক্রম নিয়মে পরিণত হয়নি। অথচ এই সঙ্কট আমাদের কাছে একটা সুযোগ ছিল, নৃশংসতার সংস্কৃতি ছুঁড়ে ফেলে, শুভাশুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানবধর্মকে আপন করে নেওয়ার।

ইংরেজি বিভাগ, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy