প্রতীকী ছবি।
পৃথিবী নামের গ্রহটা ঘুরে চলেছে নিজের নিয়মেই, শুধু তার সর্বশ্রেষ্ঠ জীবটাই আজ খানিকটা যেন হারিয়ে ফেলেছে নিজের চলার ছন্দ। সৌজন্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা অণুজীব। এক জন এক জন করে যাত্রী যেন নিজের গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই নেমে পড়ছেন চলমান এই যানটা থেকে। চারপাশটা ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে আসছে, যে ভাবে শেষ স্টেশনে পৌঁছনোর আগেই ফাঁকা হয়ে আসে ট্রেনের বগি।
এ সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়েই যাচ্ছিলাম, সম্বিৎ ফিরল স্কুল না যেতে পারার কষ্টে চুপ মেরে যাওয়া এক কিশোরীর আপাতনিরীহ একটা প্রশ্নে, ‘‘একটা অদৃশ্য ভাইরাসের মোকাবিলায় গোটা দুনিয়া যদি একত্র হতে পারে, তবে কেন পারে না বাকি সব ক্ষেত্রেও?’’
চমকে উঠলাম। ক্লাস টেনের একটা মেয়ের মনে এই প্রশ্নটা এসেছে জেনে, এই অনিশ্চয়তা আর ভয়ের আকাশে যেন এক চিলতে বিদ্যুৎরেখা দেখতে পেলাম। যেখানে পৃথিবীর সব ‘রং’ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে এক লহমায়।
পৃথিবীর বয়স কমবেশি প্রায় সাড়ে চারশো কোটি বছর হবে। এই মহাবিশ্বে আমাদের পৃথিবীর ভূমিকাই যেখানে সংক্ষিপ্ততম, সেখানে মানুষের স্থান কতটুকুই বা ?
তার মধ্যে ‘আমি’ ‘আমি’ করতে করতেই আমরা কাটিয়ে ফেলছি নিজেদের সোনালি দিনগুলো। বাজারে এখন মাল্টিভিটামিনের চাহিদা বেড়েছে। রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিসের রোগী হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ালেও আমরা অনেকেই কিন্তু জমিয়ে ফেলেছি 'হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন'। ওই কী যেন বলে, নিজে বাঁচলে.....
সোশ্যাল মিডিয়ায় দরদী স্ট্যাটাস দিয়ে নিঃশব্দেই ছাঁটাই করে দিয়েছি বাড়ির কাজের মাসি বা মাসমাইনের কাজের লোকটিকে। ঠিকই তো, কাজ না করলে শুধু শুধু কেনই বা মাইনে দেব? অথচ এই আমিই মাস পেরোলেই আগে ব্যালেন্স চেক করছি, নিজের বেতনটা ঠিকঠাক ঢুকল তো? না কি কেটে নিল কর্তৃপক্ষ?
সচেতনতার প্রদীপ আমরা জ্বালাই শুধু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। এ বারে বলুন তো, কিভাবে চিনে নেব আপনাকে? আপনাদের? এত জমায়েতের মধ্যে থেকে? সবাই যে মুখে রংবেরঙের মাস্ক লাগিয়ে রয়েছেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, আপনাকেই বলছি। আপনি এখনও বুঝতে পারছেন না, উন্নত, অনুন্নত আর উন্নয়নশীলের ভেদরেখাটা আপাতত ঘুচে গিয়েছে? তাই ওঁদের সমালোচনায় মগ্ন হয়ে না থেকে এগিয়ে আসুন না ভিতরের সংবেদনশীলতাটা নিয়ে। আসুন না, যৌথ ভাবে মিলেমিশে বিপর্যয়টা মোকাবিলা করি। সব ধর্মই তো ভক্তি, নিষ্ঠা আর আন্তরিকতার কথা বলে। উপচারগুলো না হয় পরেই হবেখন।
বিগত কয়েক দশকে যে সব রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে পৃথিবী, তার সত্তর থেকে আশি শতাংশই এসেছে বন্যজীবজন্তু থেকে। অর্থাৎ এক কথায়, জুনোটিক রোগের (zoonotic disease) প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। মনে করা হচ্ছে,অরণ্য-বন্যপ্রাণ আর জলাভূমির নির্বিচার নিধনযজ্ঞ এ জন্য প্রধানত দায়ী। লকডাউনে ডুবে থাকায় এ বছর হয়তো বিশ্ব জল দিবসের কর্মসূচি (২২শে মার্চ) সে ভাবে চোখে পড়েনি আমাদের। কিন্তু সামনেই আবার কড়া নাড়ছে ১৬ই জুন জাতীয় জলাভূমি দিবস। কেন্দ্র সরকারের নীতিআয়োগ ইতিমধ্যেই সতর্কবার্তা জারি করেছে, জলশূন্য হতে চলেছে দিল্লি, চেন্নাইয়ের মতো দেশের একুশটা শহর। আর গ্রাউন্ড ওয়াটার বা ভৌমজলের কষ্টে ভুগতে চলেছেন দেশের দশ কোটি মানুষ। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে একফোঁটা পানীয় জলের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যখন শুরু হবে হাহাকার, ভেবে দেখেছেন, তখন করোনা মোকাবিলায় মানুষ হাত ধোবে না কি পানীয় জল সংগ্রহ করে রাখবে পরের দিনের জন্য? এমনিতেই ভারতবর্ষে বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব মারাত্মক।
তা হলে বোঝাই যাচ্ছে, সমস্যা কিন্তু আমাদের একটা নয়। আর ব্যবহৃত জলের বেশিরভাগটাই যখন লাগে কৃষিক্ষেত্রে। এরপর গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো, লকডাউনের সাইড এফেক্ট হিসেবে বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দা বা 'গ্রেট ডিপ্রেশনে' বিঘ্নিত হচ্ছে জীবিকাও। একটু নুন-ভাতের জোগান না থাকলে পথে নামতে বাধ্যই হবে মানুষ।
ইদানীং লকডাউনের সময় মানুষ খুঁজে চলেছেন আশা জাগানো খবর, তা সে করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সম্ভাবনাই হোক বা সংক্রমণের হারের গ্রাফ নিয়ন্ত্রণের রূপরেখাই হোক। তবে পরিত্রানের সে আশার আলোয় মুক্তিস্নানের প্রধান অন্তরায় কিন্তু হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের বিপুল জনঘনত্ব। আমেরিকায় পপুলেশন ডেনসিটি যেখানে তেত্রিশ, ভারতবর্ষে সেখানে পাঁচশ ছয় আর পশ্চিমবঙ্গ এবং কলকাতায় তা যথাক্রমে ১০২৪ এবং ২৪১০০।
মন্দির-মসজিদ-গির্জা সব বন্ধ আজ। পরিস্থিতি সহ্য করে নিজেকে গৃহবন্দি রাখাটাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ। সত্যি, কী অসহায় আজ মানুষ। এত অহং, এত সম্ভার, এত এত ক্ষেপণাস্ত্র, পরমাণুবোমা....সব বেকার। কোনও কিছুই কাজে আসছে না আজ। যে ভাবে অরণ্য ধ্বংস হয়েছে দিনের পর দিন, জলাভূমি ভরাট হয়েছে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে, তাতে এখন পরিস্থিতি সহ্য করা ছাড়া উপায়ই বা কী?
মনে রাখা দরকার,পৃথিবীর রসদও কিন্তু সীমিত। পৃথিবীর মোট ৭৮০ কোটি জনসংখ্যার ১৪০ কোটি চিন আর ১৩০ কোটি তো ভারতেরই। এত বিপুল চাপ সামলাতে ধরিত্রীও আজ যেন নাজেহাল। অথচ,আমাদের কৃতকর্মের জন্য আমরা এখনও লজ্জিত নই। সকলেই আমরা প্রধান চরিত্র হয়ে উঠতে চাই। এখনও। ভুলে যাই, চিত্রনাট্যে পার্শ্বচরিত্রের অবদানও কম নয়। বরং কোনও কোনও পার্শ্বচরিত্র নিজের কর্মকুশলতায় কখনও চাপিয়ে যান মূল চরিত্রকেও।
বর্তমান এই কঠিন সময়ে সবাইকে নিয়েই বাঁচতে হবে আমাদের। দেশের অর্থনীতি 'ভেন্টিলেটরে' চলে যাচ্ছে বলেই তো নিরাপদ আর সুন্দর পৃথিবী তৈরির জন্য নতুন করে আবার বিনিয়োগ শুরু করতে হবে। সুপার লকডাউনের মাঝেও নতুন ভাবনায় প্রকৃতির কাছ থেকে শুধু হাত পেতে না নিয়ে তাঁকেও কিছু ফিরিয়ে দেওয়া অনুশীলন করতে হবে আমাদের।
করোনা অতিমারী খানিকটা হলেও এই ক'দিনে আমাদের ধৈর্যটা বাড়িয়েছে, একজনকে দেখে পাশের জনও ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো শুরু করেছেন, এগুলো তো প্রাপ্তিই। রোগব্যাধি সামলে উঠে তাই আর হানাহানি নয়, যৌথ প্রক্রিয়াতেই আমরা করব পরিকল্পিত উন্নয়ন,শক্ত করব নতুন করে জোড়া লাগা মানববন্ধন। আমরা চিন্তাশীল,আমরা বুদ্ধিমান।
আমরাই বলতে পারি, ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে এসো করো স্নান নবধারাজলে।’ এই সমস্যামুখর দিনগুলো পার করে স্নানান্তে নতুন দিনের জন্য আমরা পা বাড়াই। পুরনো ক্লেদ ধুয়ে ফেলি জ্ঞানের নবধারাজলে। অজ্ঞানতার ক্লেদ ধুয়ে যাক স্নানে।
স্কুল পরিদর্শক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy