Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪
economy transportation

পণ্য চলাচল না বাড়লে সঙ্কট কিন্তু খুবই জটিল হয়ে উঠবে

বাড়ছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের অভাব। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাবর্মের অভাব। রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই।

বাড়ছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের অভাব। ফাইল চিত্র।

বাড়ছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের অভাব। ফাইল চিত্র।

সুপর্ণ পাঠক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২০ ২০:২৫
Share: Save:

আরও ১৯ দিন। এবং আরও কঠিন নিভৃতবাস। মে মাসের ৩ তারিখ পর্যন্ত।

লকডাউনের সীমা যে আরও বাড়বে তা আমরা বুঝে গিয়েছিলাম মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকের পরেই। আরও দু’সপ্তাহ ধরেও নেওয়া হয়েছিল। শুধু অপেক্ষা ছিল সিলমোহরের। আজ সকাল দশটায় শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের সেই নির্দেশটাই দেশবাসীকে জানালেন প্রধানমন্ত্রী।

এ দিকে বাড়ছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের অভাব। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাবর্মের অভাব। রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই। রান্নাঘরের প্রয়োজনীয় রসদ হয়ত পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তা কিনতে গেলে প্রয়োজন কাজের। বাজারে সেই কাজই শুকিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। ব্যবসা নেই বলে চাকরি ছাঁটতে শুরু করেছে অনেক সংস্থাই। আর যাঁদের আয় প্রাত্যহিক কাজের উপর নির্ভর করে, তাঁরা তো চোখে অন্ধকার দেখছেন।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় আমরা জানলাম এ বারের নিভৃতবাসের নিয়ম হবে আরও কঠিন। আরোগ্য সেতু অ্যাপটি সবাই যেন ফোনে ভরে রাখেন। আর আগামীকালের মধ্যেই জানা যাবে রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা কী ভাবে চালু থাকবে সে ব্যাপারে পরিষ্কার নির্দেশিকা!

গরির বাজার থেকে পাড়ার দোকানে ওষুধ পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য যে পরিবহণ বা সরবরাহ শৃঙ্খলটা থাকার দরকার, মুখ থুবড়ে পড়েছে সেটাই।

আরোগ্যসেতু অ্যাপটি বলে দেবে আপনার আশেপাশে কেউ কোভিড আক্রান্ত ঘোরাফেরা করছে কিনা। প্রয়োজনীয়। কিন্তু যার কাছে স্মার্টফোন নেই? সে তো জানতে পারবে না তার অজান্তে কোভিডের ছোবল তাকে কাটল কি না! অথবা কোভিড আক্রান্ত যদি স্মার্টফোন ব্যবহার না করেন? অথবা কোভিড আক্রান্তের কাছে অ্যাপ আছে কিন্তু তার জানা নেই যে সে আক্রান্ত। সরকারের কাছেও সে খবর তো পৌছয়নি তাহলে?

কিন্তু আসল সমস্যা তো পাকছে অন্য জায়গায়। প্রধানমন্ত্রী বলছেন ওষুধের অভাব নেই, খাবারও অপর্যাপ্ত। কিন্তু দোকানে ওষুধ নেই। বাগরির বাজার থেকে পাড়ার দোকানে ওষুধ পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য যে পরিবহণ বা সরবরাহ শৃঙ্খলটা থাকার দরকার, মুথ থুবড়ে পড়েছে সেটাই।

আরও পড়ুন- রাস্তাঘাট সুনসান, কিন্তু ব্রিটেনের সুপারমার্কেটগুলিতে দেদার রি-স্টক হচ্ছে!

শুধু ওষুধ নয়। একই সমস্যা প্রায় সব প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রেই। এ বার ধরুন আড়তের কথাই। তাদেরও তো মাল আনতে হবে উৎপাদনকারীর কাছ থেকেই। পাড়ার দোকানের যে সমস্যা, আড়তদারের সমস্যাও তো তা-ই। আর উৎপাদনকারী যদি অন্য রাজ্যে থাকে। সরবরাহ শৃঙ্খলের বিশৃঙখলতা কিন্তু বিস্তৃত হচ্ছেই।

আবার ধরুন স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাবর্মের কথাই। এই বর্ম বানাতে যে পরিকাঠামোর দরকার, তা অনেকেরই আছে। কিন্তু তা বানাতে যে বিশেষ কাপড়ের দরকার তা বাজার না খুললে আসবে কোথা থেকে? আর শুধু কাপড়েই তো হবে না। লাগবে তো আরও অনেক কিছুই। যেমন ইলাস্টিক। আর তার প্রতিটির সহজ সরবরাহের ব্যবস্থা করতে না পারলে সুরক্ষাবর্মের উৎপাদন অব্যাহত থাকবে না। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা কী ভাবে হবে? আড়তদারই বা কী ভাবে সুরক্ষাবর্মের কাঁচামাল আনবেন উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে?

এই শৃঙ্খল কিন্তু আরও জটিল হয়ে উঠছে প্রতিটি দিন। লকডাউন কম দিন হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের হিসাব একরকম। সময় বাড়লে কিন্তু বাড়তে থাকে আবশ্যিক পণ্যের তালিকাও।

এই বাজারে কাজ হারালে কাজ ফিরে পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। এঁরা কী ভাবে বাঁচবেন?

সরকার বলছেন বাড়িতে থাকতে। কিন্তু জীবনযাপনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যে অনেক আপাত অপ্রয়োজনীয়তার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। বাড়িতে জল ওঠে পাম্পে। কিন্তু হঠাৎ পাম্প খারাপ হয়ে গেলে? মনে হয় অর্বাচীনের প্রশ্ন। কিন্তু বাঁচা যাবে পাম্প ছাড়া? কী ভাবে ঠিক করা যাবে পাম্প, লকডাউনের বাজারে? ইলেকট্রিসিয়ান জুটলেও কোথা থেকে আসবে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ? ব্যাটারি না থাকলে এসি চালাতে পারবেন না। অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু যখন তা টর্চ জ্বালাতে প্রয়োজনীয়? এবং গ্রামে বা চিকিৎসার যন্ত্র চালাতে? তার মানে তো ব্যাটারি উৎপাদন চালু রাখতে হবে! তার ব্যবহার কে কী ভাবে করছে তা না ভেবেই। এবং তা যাতে সহজলভ্য হয় তাও দেখতে হবে।

এবং এই অঙ্কে কিন্তু আপনার বাড়ির বাল্বও আপনার কাছে অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু বাল্ব বা টিউব যদি কেটে যায় ওই জায়গাটি কিন্তু অন্ধকারেই থাকবে, কারণ পাড়ার অতি প্রয়োজনীয় ইলেকট্রিকের দোকানটির ঝাঁপ যে বন্ধ। বলেছিলাম লকডাউনের সময়সীমা বাড়লে, বাড়বে প্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকাও। দু’সপ্তাহের লকডাউন হলে রান্নায় প্রয়োজনীয় মশলা প্রয়োজনীয় নাও হতে পারে বিস্তৃত অর্থে। কারণ মাসকাবারির পণ্য হিসাবে আমাদের হেঁসেলে তা ঢুকেই বসে আছে। কিন্তু মাস শেষ হলে? হয়ত অতি সরলীকরণ হয়ে গেল, কিন্তু এই উদাহরণটি ওষুধে বিস্তৃত করলেই বোঝা যাবে কী বলছি।

সরকারের দাবি ৩২ লক্ষ্য টন হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন মজুত আছে দেশে। বাজারে যা চাহিদা, তাতে এ দিয়ে আমাদের বেশ কয়েক সপ্তাহ চলে যাবে রফতানি করেও। কিন্তু এ বার যদি এর উৎপাদন ও বন্টনের শৃঙ্খলে কোনও ছেদ পড়ে লকডাউনের কারণেই, তা হলে কিন্তু মজুত শেষ হওয়া আর বাজারে নতুন সরবরাহ আসার মাঝে একটা বড় ব্যবধান তৈরি হবে। তার মূল্য চোকাতে হবে রোগীদের। জীবনের মূল্যেই।

আরও পড়ুন- কবি-রাজ রবীন্দ্রনাথ: পাঁচন দাওয়াই কি এখন করোনায় কাজ করবে?

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আগামিকাল বুধবার তাঁর সরকার বিস্তৃত জানাবেন প্রলম্বিত লকডাউনের নানান নিয়ম। এই নিয়মে অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর কথা থাকবে তো? উৎপাদন চালু করার ইঙ্গিত রয়েছে। কিন্তু তা কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কী ভাবে হবে চোখ থাকবে সে দিকেও। আর এই সব ক্ষেত্রের মধ্যে পণ্য যোগাযোগ কী ভাবে গড়ে উঠবে বাজার দেখতে চাইবে তা-ও। একটা সমস্যা কিন্তু আমাদের চোখ এড়িয়েই যাচ্ছে। আর সে সমস্যা হল চাকুরিজীবীদের নিয়ে। এই বাজারে কাজ হারালে কাজ ফিরে পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। এঁরা কী ভাবে বাঁচবেন?

লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু ২১ দিনের পরে আরও উনিশ দিনেই কি উঠবে লকডাউন? যে যুক্তিতে লকডাউন বাড়ানো হল সেই কারণ এই রোগের হিসাবেই আর ১৯ দিনেই ফুরোবে না। আর অর্থনীতির চাকাও ঘোরাতে না পারলে এ লড়াই জেতাও সহজ হবে না। সরকারের সামনে তুলনামূলক ভাবে সহজ পন্থাটি ছিল লকডাউন। এ বার সেই লকডাউনের মূল যুক্তি না এড়িয়েও হেঁসেলের আঁচ কী ভাবে জ্বালিয়ে রাখতে চাইছেন মোদী সরকার কাল সেটাই দেখার।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE