Advertisement
২০ জানুয়ারি ২০২৫
Coronavirus

করোনার আতঙ্কেই হয়তো মানুষ ফের দেখছে পাখিদের

করোনাভাইরাসই হয়তো আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে হারিয়ে যাওয়া পাখিদের। লিখলেন মেহেদি হেদায়েতুল্লা বাতাসে ভেসে আসা একটা মিষ্টি গন্ধে ঘুম ভেঙেছে অদ্রিজার। মন জুড়ানো সুরে কে যেন গান গাইছে তার জানালার পাশে।

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২০ ০৯:০৮
Share: Save:

সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙছে মানুষের। ভোরের বাতাসে মিলছে শুদ্ধতার অনুভূতি। রাস্তায় নেই কর্কশ হর্ন। নেই রেলগাড়ির শব্দ। করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গোটা দেশ জুড়ে চলছে লকডাউন। মানুষ বন্দি। রাস্তায় থমকে গাড়ির চাকা। আকাশে উড়ছে না উড়োজাহাজ। বাতাসে নেই তেমন ধুলোবালি বা ধোঁয়া। পোয়াবারো প্রকৃতির! দেখা যাচ্ছে পরিবর্তন।

সকালে ঘুম ভেঙেই পাখির কিচিরমিচির শেষ কবে শুনেছেন, এই প্রশ্নে রায়গঞ্জের বাসিন্দা মধুমিতা চক্রবর্তী জানালেন, আজ প্রথমবার কয়েকটি কাঠঠোকরা পাখি দেখেছেন তিনি। শুনছেন পাখির কিচিরমিচির। করোনাভাইরাসের জন্য ঘরে বন্দি থেকে যখন সব কিছু খারাপ লাগতে শুরু করে, তখন প্রকৃতিই জোগায় আলাদা আনন্দ।

বাতাসে ভেসে আসা একটা মিষ্টি গন্ধে ঘুম ভেঙেছে অদ্রিজার। মন জুড়ানো সুরে কে যেন গান গাইছে তার জানালার পাশে। ঘুম চোখে বাইরে থাকায় সে। কী দারুণ দৃশ্য! তাদের বাড়ির ঠিক একটা বাড়ির পরে পলাশ গাছটার ডালে ছোট একটা লাল ঝুঁটি তোলা বেগুনি আর খয়েরি রং মেশানো পাখি। লেজ নাচিয়ে গাছটার ডালে বসে শিস দিচ্ছে। অদ্রিজা তার দিকে একটানা তাকিয়ে রইল। তবু পাখিটার ভয় নেই! বরং অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে আরও দু’বার শিস দিয়ে একসময়ে উড়ে চলে গেল।

সাতসকালে এমন দৃশ্য দেখে বিস্মিত অদ্রিজা। এত সুন্দুর পাখি সে আগে কখনও দেখেনি।

অদ্রিজা শিলিগুড়ি শহরের মেয়ে। খুব কম পাখি দেখার অভিজ্ঞতা তার। এ ব্যাপারে বই তার একমাত্র অবলম্বন। বইয়ের পাতায় কিছু পাখির ছবি দেখেছে ঠিকই, তবে বাস্তবের অভিজ্ঞতা তার এই প্রথম। বইয়ের পাখিরা তো আর শিস দিয়ে গান করে না! অদ্রিজার মা বললেন, ‘‘শিলিগুড়িতে এক সময় কত পাখি ছিল। প্রত্যেকদিন পাখির শব্দে ঘুম ভাঙত। সেই সকালগুলো আজ অতীত। অট্টালিকার উত্থানে সব হারিয়ে গিয়েছে।’’ এ দুঃখ শুধু অদ্রিজার নয়। গোটা শিলিগুড়ির। বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ, একদিকে দূষণ, অন্যদিকে যন্ত্রসভ্যতার চাপ কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে পাখিদের স্বাভাবিক বাসস্থানগুলি। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। কিন্ত এ সব পাখি চিনতে হচ্ছে বইয়ের পাতায়। অথচ পাখির সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্ব প্রাচীনকাল থেকে। ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা বাদ দিলে বারবার মানুষের অনেক সুখদুঃখের সঙ্গী হয়েছে পাখি।

শুধু শহর নয়, গ্রাম বাংলার বুক থেকেও নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে হরেক রকমের পাখি। বাংলার মাঠঘাট, নদী, খাল বিলে যাদের এক সময় ছিল অবাধ বিচরণ। আবার, এই করোনার সৌজন্যে পাখি মানুষের চিরন্তন সম্পর্কের রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলো যেন ফিরে এসেছে। করোনাভাইরাস কি প্রকৃতির কাছে কিছু ক্ষেত্রে আশীর্বাদ হয়ে এল? লকডাউনে মানুষ ঘরবন্দি হওয়ায় কমে গিয়েছে পরিবেশ দূষণ। যার ফলে বাতাস হয়ে উঠেছে নির্মল। পরিবেশের দূষণ কমে যাওয়ায় আবার দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন রকমের পাখির দলকে। তারই প্রতিফলনে মানুষ আবার দেখছে কাঠঠোকরা। গ্রামে ফিরেছে চেনা কোকিল, টুনটুনি, শামুকখোল, ফিঙে, শালিক, দোয়েল, বক,পানকৌড়ী ও সারস, কোয়েল,গাংচিল ও বাবুইয়ের মতো অতি পরিচিত পাখি। গ্রামে দেখা যাচ্ছে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা তৈরির ছবি।

আসলে পরিবেশের নানা ধরনের পরিবর্তনের জন্যই কমে গিয়েছিল বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। পরিবেশবিদদের মতে, দূষণ নানাভাবে পাখিদের ক্ষতি করছিল। জলাশয়ে দূষণ হলে পাখিদের পক্ষে সেখানে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া জলাশয়গুলোও একের পর এক বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে। নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে গাছ। গাছ তো পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থল। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এ সব পাখি হয়ে যাচ্ছে গল্প আর ইতিহাস। এই প্রজন্মের অনেক শিশু কিশোর কখনও দেখেনি মুক্ত আকাশে উড়ন্ত এ সব পাখি, শোনেননি এদের ডাকও। তবে, করোনাভাইরাসই হয়তো হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী পাখিদের আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে জনপদে। তাদের আবার দেখা যাচ্ছে ঘরের দুয়ারে। পরিবেশবিদদের বিশ্লেষণ করোনা শিক্ষা দিল, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। তাই পাখিরা ফের যাতে হারিয়ে না যায়, তাই পরিবেশবিদদের পরামর্শ, এই দিকে নজর রেখে চলতে হবে আমাদের। সে কেমন? যেমন, গাছ লাগাতে হবে। পাখির জন্য অভয়ারণ্য তৈরি করতে হবে। করোনার ত্রাসে এখনও শিক্ষা না নিলে ফের হয়তও নতুন কোনও ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে যাবে। মানুষকে গৃহবন্দি করে দাপট দেখাবে প্রকৃতি। মুক্ত আকাশে ডানা মেলবে পাখির দল।

পরিবেশবিদ তথা পাখিপ্রেমী, ইসলামপুরের বাসিন্দা জয়দীপ মণ্ডলের দাবি, ‘‘পাখির সংখ্যা কমে গেলে শুধু প্রকৃতি সৌন্দর্য হারাবে না, সমস্যায় পড়বে মানুষও। এখন যে সমস্যাগুলির জন্য পাখিদের অস্তিত্ব সমস্যায় পড়েছে, মানুষের অস্তিত্ব একইভাবে সঙ্কটে পড়বে।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘জীববৈচিত্র্য হল প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ভারসাম্য রক্ষার একটা মাধ্যম। প্রকৃতি রুষ্ট হলে এমন অভিশাপ ফের আসবে।’’

(লেখকের মতামত ব্যক্তিগত)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy