ক’দিন ধরেই নাগাড়ে ঘ্যানঘ্যান করছে ছেলেটা, ‘‘আব্বু কখন আসবে?’’ ইদ। এ দিকে, বাড়িতে সেমুই আসেনি। লাচ্চা আসেনি। কেনা হয়নি নতুন জামা-প্যান্টও। ইদের কোনও আয়োজনই নেই বাড়িতে।
বছরসাতেকের ছেলেটা শুধু আম্মির পায়ে পায়ে ঘুরছে আর জানতে চাইছে, ‘‘ও আম্মি বলো না, ইদ চলে এল, আব্বু আসছে না কেন?’’
আম্মি শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আর তাকিয়ে থাকেন ‘আনস্মার্ট’ ফোনটার দিকে। একটা সময় ফোনের সবুজ বোতামে চাপ দিলেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে আসত, ‘‘টাকা পাঠিয়েছি। পেয়েছ? রায়হান ইস্কুলে যাচ্ছে? কই, দাও ওকে। এক বার কথা বলি।’’
এ প্রান্ত থেকে রায়হানও শুনিয়ে যেত ফিরিস্তি, ‘‘আব্বু, এ বার ইদে ছ’পকেটওয়ালা প্যান্ট নেব। বাড়ি কবে আসবে? এক সঙ্গে বাজার যাব।’’
ফের ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসত আশ্বাস, ‘‘হবে রে ব্যাটা, হবে। সব হবে। আগে বাড়ি যাই।’’
এখন ফোনটা অসহায়ের মতো পড়ে থাকে টুলের উপরে। সবুজ বোতামে চাপ দিলেই শোনা যায় যান্ত্রিক আওয়াজ— বিপ...বিপ...বিপ...রাজিয়া বুঝতে পারেন না, লোকটা কেরলে গিয়েছিলেন, কিন্তু এখন ঠিক কোন মুলুকে আছেন? তিনি কি ট্রেন পেয়েছেন? না কি অন্যদের মতো এখনও অচেনা কোনও পথ ধরে হেঁটে চলেছেন বাড়ির দিকে?
কখনও কখনও কু ডাকে মন— লোকটার ভাল-মন্দ কিছু হয়ে গেল না তো! ফের রাজিয়া চাপ দেন সবুজ বোতামে। ওপ্রান্ত থেকে কোনও সাড়া মেলে না। রায়হান এ বার কাঁদতে শুরু করে, ‘‘আব্বু কখন আসবে?’’
এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, ডোমকল থেকে ডালখোলা, বহরমপুর থেকে বাহাদুরপুর, মুরুটিয়া থেকে মালদহ, আলিপুরদুয়ার থেকে আমতলা, সন্দেশখালি থেকে সাঁকরাইল, কোচবিহার থেকে কাটোয়া— এ রাজ্য তো বটেই, তামাম দেশের যে কোনও প্রান্তে গিয়ে খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন
রায়হান, রাজিয়াদের।
ভিন্ রাজ্যে কাজে যাওয়া কিছু শ্রমিক এলাকায় ফিরেছেন। কিন্তু এখনও ঘরে ফিরতে পারেননি। করোনাভাইরাসের সৌজন্যে গ্রামেরই কোনও স্কুল বা কোয়রান্টিন সেন্টারে থেকে গিয়েছেন। বহু শ্রমিক এখনও ঘরে ফিরবেন বলে হেঁটে চলেছেন অনন্ত পথ। আর সামান্য কিছু লোকজন যাঁরা বাড়ি ফিরতে পেরেছেন তাঁদের পকেটে কানাকড়িও নেই। চড়া দামে ট্রেনের টিকিট, দালালকে উৎকোচ ও বিপুল টাকা দিয়ে ট্রাক ভাড়া করতে গিয়ে সব জমানো টাকা শেষ।
কেউ কেউ আবার বাড়ি ফিরে এসে দেখেছেন, ঘরটা আছে ঠিকই, কিন্তু আমপান উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে ঘরের চালা। এই অবস্থায় তিনি নতুন চালা বাঁধবেন না কি প্রাণ বাঁচাতে চালের বন্দোবস্ত করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। ডোমকলের তাইবুল বিশ্বাস, আব্দুল বিশ্বাস, রানা মণ্ডলেরা বলছেন, সে বার ইদের আগে বানে ভাসল কেরল। চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ বারের এই লকডাউন, আমপানের কারণে যা হল, তার সঙ্গে কোনও তুলনাই যথেষ্ট নয়।
অভাবের সংসারে বারো মাসে বারোশো সমস্যা। সকাল থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত শুধু নেই আর নেই। আর সেই কারণেই স্ত্রী, সন্তান, পরিবার রেখে ওঁরা পাড়ি দেন কেরল, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, কাশ্মীর। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, কোনওরকমে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে ওঁরা বাড়িতে টাকা পাঠান। সেই টাকায় গতি পায় সংসারের চাকা। সেই টাকায় মসৃণ হয় গ্রামীণ অর্থনীতিও।
ইদ হোক বা পুজো, বাজার কেমন জানতে চাইলে বহু ব্যবসায়ীই হাসতে হাসতে উত্তর দেন, কেরল পার্টি এলেই বাজার জমে যাবে। ‘কেরল পার্টি’ মানে ভিন্ রাজ্য থেকে ফেরা এই শ্রমিকেরাই। এ বারও বহু ব্যবসায়ী, চেম্বার অব কমার্সের বহু লোকজন জানিয়েছেন, ভিন্ রাজ্যের শ্রমিকেরা আগের মতো অবস্থায় ফিরলে কিছুটা বাজার উঠত। কিন্তু ওঁরা যে ভাবে ফিরছেন, তাতে এ বার বাজার শেষ!
আপদে-বিপদে মানুষ বাড়ি ফিরতে চান। এটাই স্বাভাবিক। এই শ্রমিকেরাও তাই ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ ভাবে ফেরাটা কি কাম্য ছিল? লকডাউনের আগে তাঁদের কথা কেউ ভাবলেন না। অনেক পরে ট্রেনের বন্দোবস্ত করা হল, কিন্তু চড়া দাম টিকিটের। যাঁরা পারলেন, তাঁরা ট্রেনে উঠলেন। যাঁরা পারলেন না, তাঁরা হাঁটতে শুরু করলেন।
কাজ বন্ধ, জমানো টাকা শেষ, পেটে দানাপানি নেই, মাথার উপর গনগনে রোদ। কচি ছেলেটা হাঁটতে হাঁটতে নেতিয়ে পড়েছে। কাঁধে তুলে নিয়ে তার বাবাও সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ‘‘আর একটুখানি বাবা। তা হলেই বাড়ি।’’ আরও কতটা হাঁটলে সেই ‘একটুখানি’ শেষ হবে, তা জানেন না ছেলেটির বাবাও। পা আর চলতে চাইছে না। তবুও তিনি হাঁটছেন। তাঁরা হাঁটছেন? না কি হেঁটে চলেছে আমার পোড়া দেশ!
এ ভাবে হাঁটতে হাঁটতেই ক্লান্ত শরীরে ট্রেনলাইনে শুয়ে পড়ে ট্রেনে পিষ্ট হয়ে মারা গেলেন ১৬ জন শ্রমিক। আরও বহু শ্রমিক মারা গেলেন পথ দুর্ঘটনায়। খিদে, অপমান, লাঞ্ছনা, অপমান সয়েও ওঁরা বাড়ি ফিরতে চান। খালি পেটে, প্রখর রোদেও ওঁদের চোখে ভাসে গাঁয়ের বাড়ি, কাঁঠাল গাছের মিঠে ছায়া, টলটলে পুকুর আর দু’মুঠো গরম ভাত।
কেউ কেউ আবার আচমকাই যাত্রাপথে টেনে দেন দাঁড়ি।
বৃহস্পতিবার তেলঙ্গানার গ্রামে এক কুয়ো থেকে উদ্ধার হয়েছে ন’জনের দেহ। তাঁদের মধ্যে ছ’জন পশ্চিমবঙ্গের এবং একই পরিবারের। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান, এটা গণ-আত্মহত্যা! মকসুদ আলম ও তার পরিবারের আরও পাঁচ জনের এ বারের ইদের চাঁদ দেখা হল না! তাঁরা কি আর কোনও আলোই দেখতে পেলেন না বলে শেষতক বেছে নিলেন কুয়োর নিটোল অন্ধকার?
ঘটনার উপরে ঘটনার প্রলেপ পড়তে পড়তে কত ঘটনাই তো ক্রমশ ফিকে হয়ে যায়। এ সবও কি কেউ মনে রাখবেন আজীবন?
এত শত জটিল তত্ত্ব মাথায় ঢোকে না রায়হান, সাবানা, পারভিনদের। কারও চায়, ছ’পকেটওয়ালা প্যান্ট, কারও চায়, রংবেরঙের চুড়ি, কেউ চেয়ে বসেছে মেহেন্দি। তবে সবচেয়ে তারা বেশি চায়, ‘‘আব্বু, বাড়ি ফিরুক।’’
পথের ধারে দীর্ঘক্ষণ লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে থাকার পরে বৃদ্ধা চোখের জল মুছে যেই বাড়ির দিকে হাঁটা দেবেন, ঠিক তখনই পিছন থেকে কেউ বলে উঠুক— ‘‘ও আম্মি, এই দ্যাখো, চলে এসেছি।’’
সাড়া দেয় সবুজ বোতাম, ‘‘মোড়ের মাথা থেকে টোটোতে উঠলাম। এই এলাম বলে!’’
ইদের দিব্যি, আপনারা বাড়ি ফিরুন! ভাল ভাবে। সুস্থ ভাবে। সেমুই, লাচ্চা, মাংস, বিরিয়ানি, নতুন পোশাক না হয় পরেও হবে, এখন সবার ঘরে গরম ভাতের গন্ধ উঠুক।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy