Advertisement
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Coronavirus

মহামারি, রাজধর্ম ও প্রজাকল্যাণ

করোনাভাইরাসের আতঙ্কে আজ দিশেহারা বিশ্ব। গোটা বিশ্ব কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করোনা-অতিমারির হাত থেকে বাঁচতে যুদ্ধে নেমেছে। মহামারি আগেও দেখেছে উত্তরবঙ্গ। তখন দেশীয় রাজ্য কোচবিহার। প্রজাবৎসল মহারাজােদের সেই হার না মানা লড়াইয়ের কথা আজও স্মরণ করেন মানুষ। প্রজাকল্যাণে রাজধর্ম পালনের নজির তৈরি হয়েছিল। সংক্রামক রোগের মোকাবিলায় গড়ে তোলা হয়েছিল হাসপাতালও। এই মহামারী অনেকেরই চেনা, অনেকেরই জানা। অন্ততপক্ষে কোচবিহারে।

নমিতেশ ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২০ ০৩:৪১
Share: Save:

একটা ক্ষীণ ছায়া ঘুরে বেড়ায়। দূর থেকে হাতছানি দেয় শত শত মুখ। সমস্বরে বলে ওঠে— আরও আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছে ছিল আমাদের!’ বাইরে লকডাউন চলছে। চার দেওয়ালের ভিতর বন্দি হয়ে থাকা কয়েকটি জীবন আঁকিবুঁকি করছে। একটা কালো অন্ধকারের ছবি আঁকছে কেউ কেউ। প্রিয়জনদের চোখে-চোখ রেখে স্মৃতিকাতর হয়ে যেতে চাইছে। কেউ কেউ আলোকবিন্দু আঁকছে। একটা সূর্য, একটা পাহাড়, একটা সমুদ্র আঁকতে চাইছে। তবুও ওই কালো অন্ধকার যেন তার দীর্ঘতর ছায়া নিয়ে ক্রমশ এগিয়ে আসছে আমাদেরই দিকে। এই প্রজন্ম কখনও মহামারির মুখোমুখি হয়নি। মৃত্যুকে এত কাছ থেকে কখনও বোধ হয় কেউ দেখেনি। শুধু একটি মাস্ক আর কয়েক ফুটের দূরত্ব। উহান-নিউ ইয়র্ক-স্পেন! যেন মৃত্যুপুরী। মুম্বই-দিল্লি-কলকাতা। মহামারির এক আতঙ্ক প্রত্যেকটি পরতে পরতে।

এই মহামারী অনেকেরই চেনা, অনেকেরই জানা। অন্ততপক্ষে কোচবিহারে। আজ থেকে একশো বছর আগে এই মহামারীর মুখোমুখি হয়েছিল কোচবিহারে। ইতিহাসে যার উল্লেখ পাওয়া যায়। অনেক প্রবীণের মুখে মহামারির পরে বছরের পর বছর কী ভাবে আতঙ্কের দিন কেটেছে, শোনা যায় সেই গল্প। ১৮৯১ সাল। সিংহাসনে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ। কোচবিহার থেকে ওই সময় তীর্থ করতে বহু মানুষ ভিনরাজ্য ও জেলায় যেতেন। সেই সময় নারী-পুরুষের একটি দল অর্ধচন্দ্রোদয় যোগে ভিন জায়গায় গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই কলেরা নিয়ে ফিরেছিলেন তাঁরা। নিমেষের মধ্যে সেই কলেরা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে গ্রামে। দিনহাটা থেকেই প্রথম তা শুরু হয়। এর পরে মাথাভাঙায়। পরে কোচবিহার শহরে। তার আগেও ১৮৮২-৮৩ সাল এবং ১৮৮৭-৮৮ সালেও কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। উল্লেখ রয়েছে, ওই সময় দিনহাটা ও মাথাভাঙা মিলিয়ে দু’হাজার এবং কোচবিহার শহর লাগোয়া এলাকায় অন্তত ৫০০ মানুষের মৃত্যু হয়। কোচবিহারের মহারাজা ছিলেন প্রজাবৎসল। তিনি আগে থেকেই কোচবিহারে চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। সেই সময়ই গড়ে তোলা হয়েছিল প্রজাদের কোচবিহার শহরে হাসপাতাল। সেই হাসপাতালে স্থানীয় চিকিৎসক ছাড়াও ছিলেন একজন ইউরোপীয় চিকিৎসক।

সেই চিকিৎসকেরা হাসপাতাল তো বটেই, বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও বাসিন্দাদের সুস্থ করে দেওয়ার কাজ শুরু করেন। কিন্তু তখনকার অবস্থা এবং এই সময়ের অবস্থা অনেকটা একই রকম ছিল। করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক ঠিক কী, তা গোটা বিশ্ব এখনও জানে না। সেই সময়ও কলেরা রোগ এবং তাঁর ওষুধ সম্পর্কে তেমন কোনও ধারণা ছিল না কারও। অনেক মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে গাছের তলায় আশ্রয় নিতে শুরু করেন। অনেকেরই ধারণা ছিল, বাড়ি থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে ওই রোগ। আবার কেউ কেউ বাড়ি থেকে দূরে গাছগাছালির ভিতর ছোট্ট কুঁড়েঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আসলে, আজকের কোয়রান্টি-পর্ব শুরু হয়েছিল সে সময় থেকেই। পরে অনেকবারই কলেরা বা বসন্ত রোগেও কোয়রান্টিনে থাকতে দেখা গিয়েছে বাসিন্দাদের। মহারাজা ওই সময় হার না মানা যুদ্ধে নেমেছিলেন। পরিবেশ দূষণমূক্ত করতে নানাবিধ কাজ শুরু করা হয়। কোচবিহার স্টেট হেলথ সার্ভিস কাজ শুরু করে। ধুনো, গন্ধক, আলকাতরা জ্বালিয়ে অনেকেই পরিবেশ পরিশোধন করতে শুরু করেন। মহারাজা সেই সময় পানীয় জলের পরিকাঠামো গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। একটা সময় কোচবিহারে পানীয় জল তেমন কিছুই ছিল না। গ্রামের অনেক মানুষই পুকুর বা নদীর জলের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। একটু আর্থিক ক্ষমতা থাকলে বাড়িতে কুয়ো বসানো হত। মহারাজার উদ্যোগে সেই সময় বহু জায়গায় নলকূপ বসানোর কাজ শুরু হয়।

তখন লোকসংখ্যা খুব কম ছিল। জনঘনত্ব কম ছিল। কিন্তু প্রতিকারের পথও ছল অন্ধকারাচ্ছন্ন। তবু মহারাজার লড়াইয়ে অবশেষে বন্ধ হয়েছিল মৃত্যুমিছিল।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus COVID-19 History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy