প্রতীকী ছবি
কয়েকটি টুকরো ছবি। সল্টলেকের এক তরুণ চিকিৎসক জানালেন, তাঁর তিনজন বয়স্ক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে মারা গিয়েছেন। তিনজনের কেউই করোনা আক্রান্ত নন। তা হলে কেন ভর্তি করা গেল না? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, বেড নেই। অর্থাৎ ওই তিনজনকে মারা যাওয়ার আগে কোনওই চিকিৎসা করতে পারেন নি চিকিৎসক। চিকিৎসা করতে পারলে, তিনজনের দু’জন অন্তত এ-যাত্রায় বেঁচে যেতেন— একজনের মূত্রনালীতে সংক্রমণ ছিল, অন্যজনের ফুসফুসে। করোনা সংক্রমিত হলে তো কথাই নেই, অন্য অসুখেও এখন হাসপাতালে ভর্তি হতে ‘মামার’ জোর দরকার। শোনা গেল, সদ্য প্রয়াত নামী ইতিহাসবিদ হরিশঙ্কর বাসুদেবনকেও সল্ট লেকের বেসরকারি হাসপাতালটিতে ভর্তি করতে খুব জোরাল এক আইএএস ‘মামা’র প্রয়োজন হয়েছিল। তবে কি হাসপাতালও এখন গণ্ডগোলের রোগীর হ্যাপা এড়াতে চাইছে? এ কি বিজ্ঞানের যুক্তি? না ব্যবসার?
মৃতদেহ— যে হাঁচেও না কাশেও না, যাকে চাদরে মুড়ে পোড়ালে সংক্রমণের সম্ভাবনা নেই, তাকেও নিমতলা-কেওড়াতলার চুল্লিতে সৎকারে বাধা দেওয়া হয়েছে, ফলত, তা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোন এক ধাপার মাঠে। সেখানেও ভিড় করে আসছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। এই যে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এত লোক জড় হচ্ছেন, তাও খুব আশ্চর্যের। নেপথ্যে যে কোনও পাকা মাথার খেলা নেই, তাও বলা যাবে না। এই প্রতিবাদী জনগণের একটি কমিউনিটি কিচেন চালাবার উদ্যোগ নেই, এইসব অন্ধতা-অযুক্তি-কুসংস্কারের প্রচারে উদ্যম প্রচুর।
করোনায় মৃতদের দেহ তো তাঁদের পরিবারের অনুমতি নিয়ে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ব্যবচ্ছেদের জন্যও দেওয়া যায়। ছাত্রদের শিক্ষার কাজে লাগে। তাও নাকি দেওয়া হচ্ছে না।
আরও পড়ুন: এই প্রকৃতিতে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ানো কত ক্ষণের?
এক-একজন করোনা আক্রান্তকে প্রায় গ্রেফতার করবার ভঙ্গিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ফলে প্রতিবেশীদের কাছে তিনি তদ্দণ্ডেই অচ্ছুৎ। তাঁর বাড়ি ছাড়ার পর, পরিবার-পরিজনকেও বাড়িছাড়া করতে তৎপর প্রতিবেশীরা! বাড়িছাড়া করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদেরও।
এই ছবিগুলি দেখিয়ে দেয়, অদ্ভুত এক সময় এসেছে। যুক্তি নেই, বিজ্ঞান নেই, তলিয়ে ভাবা নেই, কাণ্ডজ্ঞান শিকেয়, ‘জ্ঞানী’ বাঙালি মধ্যবিত্ত অযুক্তি-অন্ধতা-অবিজ্ঞানের তালে তা তা থৈ থৈ করে চলেছে। তাদের মুখের ঝাল খাচ্ছে বিপুল নিম্নবিত্ত শ্রেণি। কলকাতার অবাঙালি, বিশেষত ধনী মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের একাংশ তো যা করছে, যে কোনও ব্যঙ্গচিত্রকে হার মানাবে— গুলঞ্চ-অশ্বগন্ধার খোঁজে তোলপাড় করছে লকডাউনের কলকাতা। এইসব খেলে নাকি ইমিউনিটি বাড়বে! খরখরে রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে ঝামা হয়ে যাচ্ছে। হাতে পায়ে লেগে থাকা ভাইরাস মারা যাবে, ইমিউনিটি বাড়বে! জানালা খুলতেও ভয়, এই বুঝি করোনা ঢুকে পড়ে! হোয়াটসঅ্যাপ আর ফেসবুক হয়ে উঠেছে কুসংস্কার-কুযুক্তি আর অবিজ্ঞান প্রচারের মাধ্যম। অকারণে উত্তেজনা ছড়ানোর যন্ত্র। অমুক পাড়ায় করোনা আক্রান্ত পাওয়া গিয়েছে, কি অমুক দোকানের কর্মচারির করোনা সংক্রমণ? সত্যি-মিথ্যে জানার দরকার নেই, চলো এই মুহূর্তেই দিকে-দিকে ছড়িয়ে দাও এই বার্তা। দুশ্চিন্তা-ভয় ছড়ানো ছাড়া আর কিছু কি হবে এতে? ওই রোগী বা সমাজের কোনও উপকার? না। তবু ছড়াতেই হবে। কী যেন এক ধর্ষকামী মানসিকতায় পেয়ে বসেছে এঁদের!
বাজারে ভিড়ের ছবি দেখে মহাচিন্তায় বাঙালি— দেশের যে কী হবে! অথচ একবারও ভেবে দেখলেন না, এইমাত্র যাঁর থেকে তিনি সব্জি কি মাছ কিনলেন, সেই বিক্রেতা যে আড়ত বা পাইকারি বাজার থেকে তা কিনে এনেছেন সেখানে কেমন ভিড়!
ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের ভূতপূর্ব ডিরেক্টর-জেনারেল নির্মলকুমার গঙ্গোপাধ্যায় (ডিএসসি, লণ্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের ফেলো) স্পষ্ট জানালেন— মৃতদেহ কাপড়ের ব্যাগে ভরে যদি পোড়ানো হয়, তার থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা শূন্য। নির্ধারিত রাসায়নিকে ডুবিয়ে রাখার পরই তা ব্যবচ্ছেদের জন্য দেওয়া হয় ছাত্রদের, অতএব শব দেওয়া যায়, দেওয়া উচিতও। করোনা আক্রান্ত হলে ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে কী-কী বিকার ঘটল, তা চাক্ষুষ জানতে পারবে ছাত্ররা।
অযুক্তি-কুযুক্তি-অবিজ্ঞান-কুসংস্কারের প্রবাহ রুখতে নিয়মিত বিজ্ঞানের স্বচ্ছ যুক্তি প্রচার করার দরকার। লাগাতার, বার বার। তবেই সচেতনতা বাড়ে মানুষের। তার বদলে সরকারি মদতে শুরু হয়ে গেল হাততালি-মোমবাতি-হ্যারিকেনের নাটক। জননেতা কুশলী নটের মতো মুখে ঠিকঠাক আলো মেখে, ক্যামেরার সামনে রেওয়াজ করা অভিনেতার মতো দাঁড়ালেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়ে গেল লকডাউনের মাহাত্ম্য। জননেতার মাহাত্ম্য প্রচার। বিজ্ঞানের নিয়মে তখন তিনটি গ্রহ কাছাকাছি এসেছে। নেতা নাকি সেই তিনটি গ্রহের শক্তি জাগিয়ে পৃথিবীকে সুস্থ-শান্ত করবার উদ্যোগ নিয়েছেন। করোনা সামলে নিলেই নাকি ভারত হয়ে উঠবে এক মহাশক্তিধর দেশ। জগৎ সভা উদার সুরে ঘোষণা করে দেবে, ভারতের পিএম আমাদের পিএম, ভারতের পথ আমাদের পথ।
এই অযুক্তি-কুযুক্তির প্রবাহকে বাধা দেওয়ার কোনও প্রয়াস এই রাজ্যেও ঘটেনি। সচেতনতা বাড়ানোর কিছু বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছে মাত্র। প্রতিটি মহল্লায়, প্রতি বাড়িতে পুরসভা-পঞ্চায়েত সহযোগে যে যুক্তিবাহী বিজ্ঞান-বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দরকার ছিল এবং এখনও রয়েছে, তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও হল না। বস্তুত, এলাকায় চোখেই পড়ল না পুরপ্রতিনিধি পিতা-মাতাদের।
এ কথা এখনও কেউ স্পষ্ট করে বলছে না, আমাদের করোনা নিয়েই থাকতে হবে আগামী বেশ কিছুদিন। স্বাস্থ্যকর্মী-স্বেচ্ছাসেবকদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে প্রচার করা দরকার, হাতেকলমে শিখিয়ে ফেরা দরকার গুটিকয়েক কথা যা এখন থেকে হবে আমাদের জীবন-যাপনের অঙ্গ। তরুণ চিকিৎসক রাজর্ষি দত্ত সোজাসাপ্টা জানালেন— প্রতিদিন কারণে-অকারণে দশ-পনেরো বার হাত ধোওয়া উচিত। বাইরে গেলে, জামাকাপড়ের মতোই, মাস্ক অবশ্যই পরতে হবে। বাড়িতে অতিথি এলে হয় ছাদে গিয়ে নতুবা কোনও নির্দিষ্ট একটি খোলামেলা ঘরে তাঁর সঙ্গে কথা বলা, এবং তা যেন যতটা সম্ভব কম হয় তা দেখা দরকার। অফিসে সেন্ট্রাল এসি’র মধ্যে কাজ করায় ঝুঁকি আছে, তার বদলে অন্য কোনও ব্যবস্থা ভাবা দরকার। কর্মচারিদের কারোর সর্দি লাগলে, অবিলম্বে তাঁকে ক’দিন ছুটিতে পাঠিয়ে গতিক বোঝা প্রয়োজন। এ ছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম করা, ঘুম, চিন্তামুক্ত থাকার জানাচেনা কথাগুলো তো রয়েছেই।
করোনা ভ্যাকসিন কবে বেরুবে, কবে সবাই পাবে তা নিয়ে চিন্তা করার জন্য বিজ্ঞানীরা আছেন, তারা চিন্তা করছেন। প্রাণযাত্রা অব্যাহত রাখতে আমাদের করোনা নিয়ে চলার স্বাস্থ্যবিধি দ্রুত আয়ত্ত করে নেওয়া দরকার। এ কথা মনে রাখা দরকার, ভ্যাকসিন কার্যকর হলেও প্লেগ নিয়ন্ত্রণ ভ্যাকসিনের জন্য হয়নি। হয়েছে ডিডিটি’র ব্যাপক ব্যবহারে র্যাট ফ্লি বিনাশ করে, ইঁদুর মেরে ও ঘরবাড়ি ইঁদুরমুক্ত করে।
আরও পড়ুন: অর্থব্যবস্থাকে বাঁচাতে হলে সরকারের খরচ কত বাড়াতে হবে
রামমোহন-বিদ্যাসাগর-শিবনাথ শাস্ত্রী-রবীন্দ্রনাথ-রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী-মেঘনাদ সাহা-রাজশেখর বসু-সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁদের রচনায় অযুক্তি-কুসংস্কার-অবিজ্ঞান প্রবাহের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যে প্রজ্ঞাবান যুক্তি, বিজ্ঞানের পরম্পরা নির্মাণ করেছিলেন, তার উত্তরাধিকারী আমরা সব যুক্তি ভুলে লকডাউনের আশ্রয়ে কাল কাটাচ্ছি। তৈরি করছি না নিজেদের লকডাউনের পরবর্তী সময়ের জন্য।
মধ্যযুগ নাকি খুব অন্ধকার সময়। শিল্প-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান সব দিক দিয়েই। এই সময়ে যখন বিজ্ঞান তুঙ্গ স্পর্শ করেছে, বিজ্ঞানের যুক্তি এড়িয়ে যারা অবিজ্ঞান-অন্ধতা-অযুক্তিকে, মধ্যযুগের অন্ধকার সময়কে, হাততালি দিয়ে স্বাগত জানিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে পথ করে দিচ্ছে, তারা আর যাই হোক মানুষের বন্ধু হতে পারে না। এরা যেন মানুষকে সেই বলির পাঁঠা বানাতে চাইছে, যে পাশের বন্ধুটির মুণ্ড ছিন্ন হতে দেখেও দূরে পালানোর চেষ্টা করে না, নিশ্চিন্তে কাঁঠাল পাতা চিবোয় এই বিশ্বাসে যে, প্রভুর দেওয়া কাঁঠাল পাতাই আমায় বাঁচাবে।
বিজ্ঞানের যুক্তি না বুঝলে আমাদের সামনে ঘোর অন্ধকার। এবং সেই অন্ধকার কাটানো শিবেরও অসাধ্যি।
(লেখক প্রাবন্ধিক ও গদ্যকার)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy