Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus

চাই প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির সামঞ্জস্য

চিরন্তন বা সনাতনের কথা উঠলে আমাদের মনে পড়ে পুরাণ-কাহিনির কথা। ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, কিন্তু ঐতিহাসিক নয় বলেই তা চিরকালীন।

বিভাস চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২০ ০০:১৮
Share: Save:

কর্মসূত্রে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ক্যাম্পাসে একটি ছাত্র সংগঠন আয়োজিত সেমিনারের পোস্টার চোখে পড়ল, ‘ক্যাপিটালিজ়ম অ্যান্ড করোনাভাইরাস’। বুঝলাম, এখানকার উঠতি বয়সের উদারপন্থী ছাত্রছাত্রীদের অনেকে ক্যাপিটালিস্ট আচরণ ও প্রকৃতির উপর অত্যাচারকে করোনাভাইরাস বা এই জাতীয় বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করতে চায়। যুক্তিসঙ্গত ভাবনা, বলতেই হবে। মানুষের লাগামহীন লোভ মানবসভ্যতাকে গভীর বিনাশের দিকে নিয়ে চলেছে। প্রতিরক্ষা বাজেট বেড়েছে, কোপ পড়েছে স্বাস্থ্য, গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেটে। কেবলই ব্যক্তিগত ও সামাজিক মুনাফা খুঁজতে ব্যস্ত আমরা এখন দেখছি, করোনাভাইরাসের সামনে কারও রেহাই নেই। এটা না হলে মানুষের টনক নড়ত না। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন, ওষুধ-ভ্যাকসিন সবই আসবে যথাসময়ে, কিন্তু তার আগে মূল্য চোকাতে হবে। এ-ই চিরন্তন সত্য।

চিরন্তন বা সনাতনের কথা উঠলে আমাদের মনে পড়ে পুরাণ-কাহিনির কথা। ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, কিন্তু ঐতিহাসিক নয় বলেই তা চিরকালীন। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ব্রহ্মা সৃষ্টির, বিষ্ণু স্থিতির আর শিব ধ্বংসের দেবতা। মজার ব্যাপার, সারা ভারতে বিষ্ণু ও শিবের পুজো ও মন্দির বিস্তর, ব্রহ্মার পুজোর তেমন চল নেই। শিবপুরাণে আছে, ব্রহ্মা তাঁর নিজের মেয়ের প্রতি কামাসক্ত হয়ে পড়লে শিব ব্রহ্মার শিরশ্ছেদ করেন। এই কুকর্মের জন্যই সম্ভবত ব্রহ্মা জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। সম্প্রতি পুরাণবিদ দেবদত্ত পট্টনায়কের লেখায় পেলাম, নিজের মেয়ের প্রতি ব্রহ্মার আসক্ত হওয়াটা একটা রূপক। ব্রহ্মার মেয়ে মানে রূপকার্থে মানুষের যে কোনও সৃষ্টি, যেখানে মানুষের অহং নিহিত। অহং না থাকলে কোনও সৃষ্টি হয় না, কারণ অহংবোধ ছাড়া সৃষ্টির প্রেরণাই থাকে না। মানুষের পরিবার, কেরিয়ার, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, সমাজ, দেশ, সবই বিভিন্ন স্তরে মানুষের অহংয়ের প্রকাশ। ব্রহ্মা মানুষের এই অহং প্রবৃত্তি, সেই অর্থে আমরা সকলেই ব্রহ্মা। আর বাজারে ব্রহ্মা যখন এতই সহজলভ্য, তাঁর তো দাম কমে যাবেই। তাই আলাদা করে তাঁর পুজো নেই, তিনি সদা জাগ্রত।

বিশুদ্ধ ক্যাপিটালিজ়ম আসলে ব্যক্তিগত অহংয়ের গোড়ায় ধূপধুনো। তাই ক্যাপিটালিস্ট সমাজে সাধারণত শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান-ব্যবসা সব কিছুর সুপ্রসার হয়। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্যই, তার অহংকে মর্যাদা দেওয়ার তাগিদেই সে সমাজ সৃষ্টি করে। কিন্তু সেই সমাজকে স্থিতিশীল রাখতে গেলে অনেক সময় সামাজিক অহংকে অগ্রাধিকার দিতে হয়, এক অহংয়ের সঙ্গে আর এক অহংয়ের ঠোকাঠুকি সামাল দিতে হয়। তাই প্রয়োজন পড়ে বুদ্ধিমান প্রশাসকের। তাঁর সব সিদ্ধান্ত ঠিক নাও হতে পারে, কিন্তু মোটের ওপর তিনি ক্ষুদ্র অহংয়ের চেয়ে সামাজিক অহংকে প্রাধান্য দেবেন, সমাজকে স্থিতি দেবেন। এখানেই বিষ্ণুরূপের কল্পনা। তিনি সুপ্রশাসনের পরাকাষ্ঠা। বলে রাখা ভাল, বিষ্ণু সামাজিক অহংকে প্রাধান্য দিলেও পুরাণে তাঁর রূপটা ঠিক সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট ধারণার মতো নয়। তিনি ক্যাপিটালিজ়মকে ধ্বংস করেন না, একটা পরিশীলিত রূপ দেন মাত্র। সুপ্রশাসকের বড় অভাব চারপাশে। বাজারে যে জিনিসের জোগান কম, তার দাম তো বাড়বেই। তাই আমাদের ঘরে ঘরে এত বিষ্ণু বা নারায়ণের পুজো। বিষ্ণুর আরাধনা মানে ঠান্ডা মাথায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উপযুক্ত নেতাকে নির্বাচন করে প্রশাসকের আসনে বসানো, তিনি তাঁর কর্তব্য ঠিকমতো পালন করতে না পারলে সচেতন ভাবে অন্য প্রশাসকের প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধ বা দুর্যোগের সময় ক্ষুদ্র রাজনীতি ভুলে প্রশাসককে সহায়তা করা, দরকারে নিজের কিছুটা ক্ষতি স্বীকার করেও সামাজিক প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

শেষে শিবের কথা। মানুষের আদিম দুটো স্বাভাবিক প্রবৃত্তি— ভয় (অর্থাৎ নিরাপত্তাহীনতা) ও ক্ষুধা (শুধু খাবার নয়, সমস্ত বাসনা)— যার উৎপত্তি অহং থেকে, যা মানুষের শান্তি কেড়ে নেয়, যুদ্ধ বা অতিমারির সময় আরও জাঁকিয়ে বসে, শিব তাদের জয় করেছেন। তিনি ত্যাগের পরাকাষ্ঠা। কিন্তু সাধারণ সংসারী জীবনেও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা আছে। তাঁর ব্যক্তিগত অহং বিশ্বপ্রকৃতির অহংয়ে বিলীন। মানুষের বেলাগাম অহং প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দকে বিপন্ন করলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। অহংতাড়িত ব্রহ্মার পদস্খলন ঘটলে শিব তাঁর শিরশ্ছেদ করেন, অহংসর্বস্ব দক্ষরাজের আস্ফালনের উত্তরে তছনছ করেন যজ্ঞ। যজ্ঞ রূপকমাত্র, প্রকৃতপক্ষে নষ্ট হয় দক্ষের সব কারবার, সাজানো বাগান। এই বিনষ্টির পিছনে থাকে শিবের চেলা ভূত-প্রেত ইত্যাদি, তথাকথিত সভ্য সমাজের বাইরের জীব। মানে আসল লড়াইটা প্রকৃতি বনাম সংস্কৃতির। দক্ষের জায়গায় ডোনাল্ড ট্রাম্প, বরিস জনসন বা শি চিনফিং, আর ভূতের জায়গায় ভাইরাসকে বসিয়ে নিলে, গল্পটা খুব পাল্টায় কি?

আসলে শিব বিনির্মাণের দেবতা। মানুষের সভ্যতা যখন অহংতাড়িত হয়ে ভুল পরিকাঠামো নির্মাণ করে চলে, বিশ্বপ্রকৃতি সেটা ভেঙে দিয়ে নতুন করে গড়ার সুযোগ দেয়। কাঁচামালের জোগান কিন্তু বন্ধ হয় না, তাই সব কিছু ধ্বংস হয় না। ধাক্কা সামলে সভ্যতা আবার চলতে থাকে নতুন পথে। ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব, প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির সামঞ্জস্য রক্ষা করাই প্রকৃত মানবধর্ম।

স্ট্যাটিসটিক্স ও কোয়ান্টিটেটিভ মেডিসিন, সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy