সত্যি, কেউ যেন একটা হাঁক দিয়ে ‘এই রোকো’ বলে পৃথিবীর গাড়িটা থামিয়ে দিয়েছে। সবাই গৃহবন্দি, সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত যেন দাঁড়িয়েছে দ্বারে। কোন ফোকর দিয়ে অশরীরী আততায়ীর মতো এই ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে, সবাই সেই আশঙ্কায় মগ্ন। আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন সম্পূর্ণ থমকে গিয়েছে। দৈনন্দিন জীবন বিপর্যস্ত, খাবার, ওষুধ এবং অন্যান্য আবশ্যিক সামগ্রীর জোগান কোথা থেকে আসবে, নিকটজন অসুস্থ হলে কী হবে, সেই চিন্তায় সবাই উদ্বিগ্ন। দূরত্ব বা বিচ্ছিন্নতা এখন আর কাব্যিক বিলাস নয়, কঠোর সরকারি নির্দেশ। বার বার হাত ধোয়া এখন শুচিবায়ুগ্রস্তের লক্ষণ নয়, জনস্বাস্থ্যের বিধি।
সারা বিশ্বে এই অসুখে মৃতের সংখ্যা বহু হাজার ছাড়িয়েছে, সর্বত্র চিকিৎসাব্যবস্থার ওপরে অকল্পনীয় চাপ পড়ছে। ভারতে এখন অবধি মৃতের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও, জনবসতির ঘনত্ব ও দারিদ্রের কারণে, রোগ এক বার ছড়ালে দাবানলের মতো দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে— সেই আশঙ্কা অনস্বীকার্য। আর তাই সরকারের তরফ থেকে যে তিন সপ্তাহ সর্বাত্মক অন্তরিন থাকার আদেশ জারি করা হয়েছে, তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন নেই।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই সঙ্কট প্রাথমিক ভাবে জনস্বাস্থ্যের সঙ্কট হলেও, তার যে অর্থনৈতিক প্রভাব, সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সঙ্কট বা সঙ্কটের ঝুঁকি সবার সমান নয়। মরণে মরণে যেমন অনেক ফারাক আছে, তেমনই মানুষে মানুষে জীবনরক্ষার সংগ্রামেও অনেক ফারাক আছে। আমাদের দেশের শতকরা নব্বই জনের বেশি লোক বাঁধা মাইনের চাকরি করেন না, বা বিত্তশালী নন। তাই ঘরে বসে থাকলে তাঁরা অসুখে না হলেও খাদ্যাভাবে মারা যাবেন, যার প্রভাব মহামারির চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। তাই শুধু গৃহবন্দি থাকার আদেশ দিলে চলবে না, তার সঙ্গে জনসাধারণের জীবনধারণের সুরক্ষারও ব্যবস্থা করা আবশ্যক। এই বিষয়ে কেরলসহ নানা রাজ্য, যার মধ্যে আমাদের রাজ্যও পড়ে, যে যে সদর্থক পদক্ষেপ করছে, এবং দিনকয়েক আগে ঘোষিত কেন্দ্রীয় সরকারের রিলিফ প্যাকেজ, এ সবই অত্যন্ত জরুরি।
শুধু তাই না, এই সঙ্কটের যে অর্থনৈতিক অভিঘাত, তার একটা সম্পূর্ণ নতুন দিক হল, এটা একই সঙ্গে জোগান ও চাহিদার সমস্যা। জোগানের সমস্যা নিয়ে বলার কিছু নেই, তা প্রত্যক্ষ ভাবে দৃশ্যমান। কিন্তু, জোগানের অভাব থেকে চাহিদার অভাব তৈরি হতে পারে। ধরুন, যিনি লোকের বাড়িতে গৃহসহায়িকার কাজ করেন, অথবা যিনি ট্রেনে হকার, এই সময়ে কাজে বেরোতে না পারার ফলে তাঁরা নিজেদের পণ্য বা পরিষেবা বাজারে জোগান দিতে পারছেন না। ফলে, তাঁদের আয়ও নেই। কাজেই দোকানে যদি পণ্য থাকেও, তাঁদের কেনার উপায় থাকবে না। সমস্যা যেহেতু চাহিদা এবং জোগান উভয়েরই, কাজেই সরকারি সাহায্য শুধু অর্থের অনুদানে হবে না, একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগানের ব্যবস্থা করতে হবে। অনুদান অর্থে দেওয়া হবে, না পণ্যে দেওয়া হবে, এই বিতর্ক এই মুহূর্তে অবান্তর।
কেউ বলতেই পারেন, সরকারের এই যে ত্রাণপ্রচেষ্টা, তার তো অনেক খরচ— তাতে তো বাজেটের ঘাটতি বাড়বে, পরে অর্থনৈতিক সমস্যা বাড়বে। কিন্তু অর্থনীতি কী? তা তো মানুষে মানুষে চাহিদা-জোগান ও পারস্পরিক নির্ভরতার এক মানবশৃঙ্খলের জাল মাত্র। মানুষই যদি না বাঁচে, ভবিষ্যতের জাতীয় আয়ই বা আসবে কোন অর্থনীতি থেকে? তাই এই মুহূর্তে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এই সঙ্কটের মোকাবিলা করা ছাড়া উপায় নেই।
এই ভয়ঙ্কর সময়ের শেষ কোথায়, এই মুহূর্তে আমরা সেটা কেউ জানি না। তবে যা আমরা সবাই জানি যে, এক বার এই দুঃস্বপ্নসম সময়ের থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে, আমাদের সব কিছু নতুন করে ভাবতে হবে। আসলে পরম সঙ্কটের মুহূর্তেই আমরা বুঝতে পারি, জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান কী। আর এই অভাবনীয় সঙ্কট কতগুলো জিনিস খুব স্পষ্ট ভাবে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে।
আমাদের নিজেদের জীবন থেকে সবচেয়ে বড় উপলব্ধি হল: এই পরম দুর্যোগক্ষণে রাষ্ট্রশক্তির বজ্রমুষ্টি বা বাজারি অর্থনীতির অদৃশ্য হাতের ওপর যখন ভরসা রাখা যায় না, সব কিছু যখন বিপন্ন, তখন আমাদের হাতে যা বাকি থেকে যায়, তা হল সামাজিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের নিরাপত্তাজাল। তার মধ্যে আছে পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী, ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এও মনে রাখতে হবে যে আমাদের দেশে সরকারি আর সংগঠিত বেসরকারি ক্ষেত্রে সব কর্মী ধরলেও মোট শ্রমশক্তির ১০-২০ শতাংশের বেশি নয়। তাই আবশ্যক পণ্যের জোগান বজায় রাখতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমজীবী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সাহায্য নিতেই হবে, সেখানে গৃহবন্দি হওয়ার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে মানুষের ওপর জোরজবরদস্তি (যাতে অন্তত এক জন মারাও গিয়েছেন বলে অভিযোগ) শুধু অমানবিক নয়, শেষ অবধি তা এই সঙ্কটকে তীব্রতর করবে। তাই, শুধু রাষ্ট্র বনাম (সংগঠিত) বাজার, এই বিতর্কে আবদ্ধ থাকলে চলবে না, আমাদের জীবন যে রাষ্ট্র, বাজার, ও নাগরিকসমাজ, এই ত্রিভুজ কাঠামোর ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভারসাম্যের কথা খেয়াল রাখতে হবে।
আর একটা শিক্ষা হল এই যে বিশ্বায়নের রথের চাকা আপাতত স্থির হলেও, বিশ্বায়ন চাই বা না চাই, কোনও এক দেশে উদ্ভূত স্বাস্থ্যসমস্যা দাবানলের মতো বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে অপরিসীম ক্ষতি করতে পারে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই কোনও দেশের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ-সংরক্ষণ সম্পর্কিত বিধি ও আচার, শুধু তাদের নিজস্ব সর্বভৌম ব্যাপার নয়। তা সম্পর্কে বিশ্বজোড়া সাধারণ বিধিনিষেধের প্রয়োগ ও সহযোগিতা অতি-আবশ্যক। দুর্ঘটনা হলে যেমন গাড়ি বা রাস্তা বাতিল না করে আমাদের নিজেদের সতর্কতা, রাস্তা ও গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ আর ট্রাফিকের নিয়মকানুন ও তার প্রয়োগ নিয়ে ভাবতে হয়, সমস্যা বিশ্বায়ন নিয়ে নয়, কোন নিয়মকানুনের কাঠামোয় তা হচ্ছে, সমস্যা সেখানে।
এই ব্যাধির সূচনা কী ভাবে হয়েছে, সে বিষয়ে যা জানা যাচ্ছে, সেটা আর একটা বিষয়ের দিকে নির্দেশ করে। মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য, তা ব্যাহত হলে কী মারাত্মক ফল হতে পারে, এই শিক্ষাটা আজ প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট। প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয় বা দূষণই যে শুধু সম্ভাব্য সমস্যা নয়, প্রকৃতির সঙ্গে মানবসমাজের ভারসাম্য বিপন্ন হলে মানবসমাজের অস্তিত্বই যে সঙ্কটে পড়তে পারে, এই বিপর্যয় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল। যাঁরা পরিবেশ-সচেতনতাকে ভাবুকদের বিলাস ভাবেন, আশা করি কথাটা তাঁরাও উপলব্ধি করবেন। তবে ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’, এই ধরনের চিন্তাও সমর্থনযোগ্য নয়। আমাদের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এই যুদ্ধের প্রধানতম সেনা। তাঁরা তো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া এই যুদ্ধ লড়তে পারেন না। আর মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট যে এখন আবশ্যক পরিষেবার অঙ্গ, তা-ও বলার অপেক্ষা রাখে না। সমস্যার মূলে যন্ত্রসভ্যতা নয়, সমস্যা তাকে মানবকল্যাণের কাজে প্রয়োগ না করে শুধু বাজারের মুনাফা বা সরকারের বজ্রমুষ্টির জোর বাড়াবার কাজে লাগানো নিয়ে।
আর একটা শিক্ষা উল্লেখ করতেই হয়। দক্ষিণপন্থী পপুলিস্ট বা জনমোহনবাদী রাজনীতির যে হাওয়া এখন দেশে-বিদেশে বইছে, তার একটা অঙ্গ হল বিজ্ঞানবিরোধিতা এবং বিশেষজ্ঞদের সম্পর্কে প্রতি সন্দেহ ও প্রত্যক্ষ বিরূপতা, কারণ এগুলো নাকি এলিটদের ক্ষমতা ধরে রাখার অজুহাতমাত্র। আজ এই সঙ্কট নতুন করে আমাদের মনে করিয়ে দিল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ও বিশেষজ্ঞদের অবশ্যপ্রয়োজনীয়তা।
তবে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল, আপনি চান না চান, অন্য মানুষের সমস্যা আপনারও সমস্যা। এই উপলব্ধি মানবপ্রেম থেকে না আসুক, নিজের অস্তিত্বরক্ষার তাগিদ থেকে আসতে বাধ্য। মানুষের আবশ্যক পণ্য ও পরিষেবা মানুষই পরস্পরকে জোগায়। আবার আর এক জনের ছোঁয়াচে অসুখ হলে, আমাদের অসুখ হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে। তাই অন্যের মঙ্গলে আমাদেরও মঙ্গল। সুতরাং কখনও যদি দরিদ্র মানুষের কথা কেন ভাবব বা জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এত বরাদ্দ কেন, এ কথাগুলো মনে হয়, ভেবে দেখবেন সেই পঙক্তিগুলি— যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
অর্থনীতি বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy