২২ মার্চ যখন ‘জনতা কার্ফু’ পালনের কথা ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যকর্মীদের উৎসাহ দিয়ে চাঙ্গা করার কথা বললেন, তখন হোয়াটসঅ্যাপ এবং গণমাধ্যমের সৈনিকরা একটু অন্য ভাবে সেই সুযোগ কাজে লাগাল। এর জ্যোতিষসংক্রান্ত তাৎপর্য থেকে অপবৈজ্ঞানিক অপপ্রচার, সবই শোনা যেতে লাগল। ব্যাপারটা এত দূর গড়াল, যে প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (পিআইবি)-কে আসরে নামতে হল। এই সব দাবি নস্যাৎ করতে বিবৃতি জারি করতে হল।
এই ঘটনা অবশ্য ব্যতিক্রম নয়, দীর্ঘ দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ধাপ্পাবাজি চলে, তারই অংশমাত্র। কোভিড-১৯’এর সংক্রমণের গোড়া থেকেই এই ভাইরাস সংক্রান্ত ভুয়ো খবর এবং ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিতে সক্রিয় হোয়াটসঅ্যাপ-সহ অন্যান্য মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম। আরোগ্যের উপায় বা সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়ে অপবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, সবই সেখানে পাওয়া যাচ্ছে। রিটুইট এবং অসংখ্য শেয়ারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই সব দাবি ভাইরাল হচ্ছে। এ ভাবে গত কয়েক দিনে তা বিপুল সংখ্যক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছেও গিয়েছে। অনুমান করা চলে, নেটিজ়েনদের বৃহদংশ ইতিমধ্যেই ভুয়ো খবরের অতিমারির শিকার।
ভুয়ো খবরের রমরমা ভারতে নতুন কিছু নয়, এবং তা বিশ্বজনীনও বটে। এর সংজ্ঞা হল, ‘বিশেষ কৌশলগত উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল তথ্য পরিবেশন’। একে ভুয়ো খবর বলা হয়, কারণ এর বিষয়বস্তু আসল ‘খবর’-এর মতো করে বানানো। উদ্দেশ্য, পাঠকদের প্রভাবিত করা। গণতন্ত্রে কোনও আলোচনাকে ভুয়ো খবর কী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তা গবেষণায় প্রমাণিত। বাস্তব ও কল্পনার এক সাঙ্ঘাতিক মিশেল ঘটিয়ে তা উপস্থিত নিরাপত্তাহীনতার বোধকে আরও চাঙ্গা করে তুলতে পারে। কিন্তু তার বিপরীতে এই রমরমা নিয়ে বেশির ভাগ আলোচনাই নির্বাচনী রাজনীতি ও নাগরিক অধিকারের উপর এর প্রভাবেই সীমিত। যদিও অতিমারি-জনিত লকডাউনের মধ্যে ভুয়ো খবরের বিস্তার জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও অহেতুক জটিলতা তৈরি করতে পারে। জনতার একটা বড় অংশ যদি বিশ্বাস করে যে ভারতীয়দের মধ্যে শক্তিশালী ‘হার্ড ইমিউনিটি’র কারণে ভাইরাসের প্রভাব নগণ্য হবে, তা হলে তারা আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়মগুলো মানবে না। বিপরীতে, যদি ভাইরাস সংক্রান্ত মিথ্যে খবরে অত্যধিক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, তা হলে খাবারদাবার জমানো শুরু হবে। যার ফলে খাদ্যদ্রব্য জোগানে টান পড়বে, যা থেকে অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হতে পারে। সুতরাং, কোভিড-যুগে ভুয়ো খবরের প্রভাব স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক।
এখন যে ভুল তথ্যের স্রোত বইছে, তা সাধারণ ভুয়ো খবরের বাস্তুতন্ত্রের থেকে আলাদা। এখানে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগোনোর জন্য এক দল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক নেতা নেই, আছে এখনকার সমস্যা থেকে সুরাহা খোঁজা বহু ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা। সরকারি নির্দেশিকার কারণে বাইরে বেরোতে না পারা এবং এর শেষ সম্পর্কেও কিছু না জানার ফলে ইন্টারনেটই হয়ে উঠেছে মানুষের যোগাযোগের প্রাথমিক মাধ্যম। মুখোমুখি দেখা হওয়ার জায়গা নিয়েছে পুরোপুরি ‘ভার্চুয়াল’ যোগাযোগ। তাই স্বাভাবিক ভাবেই লকডাউনের সময় নাগরিকরা তার শরণাপন্ন হবেন। বিশেষত, ভাইরাস সংক্রান্ত তথ্য, সংক্রমিত ও সন্দেহভাজনের সংখ্যা, চিকিৎসা-পদ্ধতিই মূল আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন ভীতি এবং অনিশ্চয়তার এক আবহই ভুয়ো খবরের মহামারি ছড়িয়ে পড়ার জন্য আদর্শ। অনেক গবেষকই বলছেন যে ভুয়ো খবরের আসল বিপদ সমাজের ভিতরেই প্রোথিত— সত্য অসুবিধেজনক হলেও যদি পূর্বনির্ধারিত ধারণার কাছাকাছি হয়, তা হলে সমাজ তা বিশ্বাস করে। যা খুশি বিশ্বাস করার এই বাসনাই আসলে সমস্যার মূল। অভূতপূর্ব মাত্রায় ছড়িয়ে পড়া এই অতিমারির সামনে— যা হঠাৎ করে আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম থামিয়ে দিয়েছে এবং যা অর্থনীতিকেও গভীর বিপদে ফেলতে পারে— এই সঙ্কটকে অনেকেরই অপ্রতিরোধ্য মনে হতে পারে। যখন বিজ্ঞানী সমাজ প্রায় মেনেই নিয়েছে যে কোনও সম্ভাব্য টিকা তৈরি করতেও অনেকটা সময় লাগবে— পরীক্ষা করে তার পরে তা ছড়াতে হবে— তখন এই সঙ্কট অলৌকিক আরোগ্যের অযৌক্তিক আশার ভিত্তি তৈরি করছে।
এমনিতে ভুয়ো খবর নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটা জটিল, যেহেতু তা অধিকারের দ্বন্দ্ব তৈরি করে। এখানে বাক্স্বাধীনতার মুখোমুখি দাঁড়ায় ঠিক তথ্য পাওয়ার অধিকার। তবে ভুল তথ্য মাত্রেই ভুয়ো খবর বলা যায় না। ধরা যাক, ভবিষ্যতের কোভিড-পজ়িটিভ কেসের সংখ্যা অনুমান করা সম্ভাব্য কোনও মডেলকে আদর্শগত ভাবে ভুয়ো খবর বলে সেন্সর করা যায় না, নিরপেক্ষ মূল্যায়ন থেকে তা দূরবর্তী হলেও। এর ফলেই নীতি-নির্ধারকদের সমস্যা তৈরি হয়। এই ধরনের মডেল সুপরিকল্পিত না হলেও তা আইনের দ্বারা সুরক্ষিত। এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করলে সেন্সরশিপ-পূর্ব যুগে ফিরে যেতে হয়, যেখানে প্রত্যেকটি জিনিসকেই আলাদা করে যাচাই করতে হবে। হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকের যুগে তেমন কোনও মডেল একেবারেই উপযুক্ত নয়। এখানে ব্যক্তি দ্বারা সাঙ্ঘাতিক দ্রুত গতিতে এবং প্রচুর পরিমাণে জিনিস আপলোড করা হতে থাকে। বাক্স্বাধীনতা খর্ব করার মতো আদর্শগত বিষয় ছাড়াও আপলোড করা প্রভূত পরিমাণ জিনিসকে যদি যাচাই করতে হয়, তবে তা পণ্ডশ্রম হবে।
ভুয়ো খবরের অতিমারি ঠেকানোর কার্যকরী উপায় একটাই— জনস্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থার কারণ দেখিয়ে এই ধরনের সংবাদ পরিবেশন পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা, এবং যাচাই না করা তথ্য ছড়ালে অপরাধমূলক জরিমানা করা। কর্নাটকের মতো কিছু রাজ্য ইতিমধ্যেই তেমন বিধিনিষেধের কথা জানিয়েছে। যেহেতু এই ধরনের খবরের উৎস জানা প্রায় অসম্ভব, অতএব ব্যক্তি পরিবেশকের উপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চাপালে এই আচরণে কিছু দূর অবধি নিরস্ত করা যেতে পারে। সেই হিসবে কোনও সামাজিক সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান সমাজ থেকেই উঠে আসতে হবে। এটা শেষ অবধি সঙ্কটের সময় ব্যক্তির বিশ্বাস ধরে রাখার ব্যাপার। বড় করে ভাবলে অবশ্য নিষেধাজ্ঞার ভয় কখনওই বিশ্বাস গঠনের পরিবর্ত নয়। এ ভাবেই— সঙ্কট আমাদের সামনে উন্মোচিত হলেও— আমাদের নাগরিকদের নজরদার হতে হবে এবং ‘ভার্চুয়াল’ গোষ্ঠীর দায়িত্বের প্রতি যত্নবান হতে হবে।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy