পিনারাই বিজয়ন। ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
এক সঙ্গে কতগুলো যুদ্ধে জিতলেন পিনারাই বিজয়ন? কোভিড-১৯ তাঁর প্রশাসনের কাছে হার মেনেছে, গোটা দুনিয়া সবিস্ময়ে স্বীকার করছে সে কথা। দেশের প্রথম করোনাভাইরাস-আক্রান্ত পাওয়া গিয়েছিল কেরলেই। যে রাজ্যে বাস করেন দেশের মাত্র ২.৫ শতাংশ মানুষ, মার্চের প্রথম সপ্তাহে সেই কেরলেই ছিলেন দেশের ২০% কোভিড-১৯’আক্রান্ত। আর, এই এপ্রিলের শেষে এসে? বেশ কয়েকটা জেলা থেকে লকডাউন তুলে নিয়েছে প্রশাসন, পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণে।
কী ভাবে কেরল সামাল দিল এই মারাত্মক অতিমারিকে, ইতিমধ্যেই বহু নিউজ়প্রিন্ট খরচ হয়েছে সেই আলোচনায়। প্রতি সন্ধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন বিজয়ন। অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য তৈরি করেছেন শিবির। তাঁদের চাহিদা মেনে রান্না করা মালয়ালি খাবারের পরিবর্তে সেই শিবিরে পৌঁছে দিয়েছেন চাল-ডাল-মশলা-আনাজ, শ্রমিকরা যাতে নিজেদের পছন্দসই রান্না করে নিতে পারেন। সেখানে লুডো-ক্যারমবোর্ড দিয়েছেন, ব্যবস্থা করেছেন সরকারের তরফে নিয়মিত শ্রমিকদের মোবাইল রিচার্জের। রাজ্য জুড়ে তৈরি করেছেন স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন— প্রত্যন্ত প্রান্তেও পৌঁছে দিয়েছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এবং অতি সম্প্রতি সেই অত্যাবশ্যক পণ্যের তালিকায় জুড়ে নিয়েছেন বইকেও। কোভিড-১৯’এর সঙ্গে লড়াইয়ে একেবারে সামনের সারিতে থেকেছেন তিনি, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
সামনে দাঁড়িয়ে লড়ার অভ্যেস অবশ্য তাঁর অনেক দিনের। ১৯৪৪ সালে জন্ম, নিম্নবিত্ত পরিবারে। বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আগ্রহ কৈশোর থেকেই। ছাত্র সংগঠন থেকে যুব সংগঠন, সেখান থেকে দলের রাজ্য সংগঠন, শেষ অবধি রাজ্য সম্পাদক— বিজয়নের রাজনৈতিক উত্থানের পাশাপাশিই চলেছে তাঁর নিজের জেলা কান্নুরে অন্য এক লড়াই। ইউডিএফ-এলডিএফ’এ ভাগাভাগি হয়ে থাকা কেরলের এই একটি জেলায় আরএসএস-এর উপস্থিতি বেশ জোরদার। আক্ষরিক অর্থেই। সিপিএম-এর সঙ্গে আরএসএস-এর বাহুবলের টক্করেও সামনের সারিতেই থেকেছেন পিনারাই বিজয়ন। ফলে, গৈরিক শিবিরের অপছন্দের তালিকার খুব ওপরের দিকে তাঁর নাম। এহেন মুখ্যমন্ত্রীর অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান। বললেন, কোভিড-১৯’এর মোকাবিলায় বিজয়নের ভূমিকা নিয়ে কোনও প্রশ্নই নেই। অবিজেপি-শাসিত রাজ্যে রাজ্যপালের মুখে সরকারের প্রশংসা, বিরল। গেরুয়া শিবিরের মুখে পিনারাই বিজয়নের প্রশংসা, বিরলতম। যুদ্ধজয় নয়?
দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বিজয়কেতন উড়িয়ে দিয়েছেন বিজয়ন, এবং বিপর্যয়ের মুখে। শুধু কোভিড-১৯ নয়, ২০১৬ সালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী নবতিপর ভি এস অচ্যুতানন্দনকে সরিয়ে প্রথম বার কেরলের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া ইস্তক বিজয়ন সামলেছেন দু’দফা বন্যা, নিপা ভাইরাসও। প্রত্যেক বারই তিনি সফল। ফলে, তাঁর বিরুদ্ধে যত প্রশ্নই উঠুক, রাজ্য প্রশাসনে ক্রমেই আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন তিনি। অচ্যুতানন্দনও বুঝেছেন, ছিয়াত্তর বছরের ‘তরুণ তুর্কি’কে মেনে না নিয়ে গতি নেই। এক অর্থে, দলের কেঠো রাজ্য সম্পাদক থেকে রাজ্যের সর্বজনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ওঠার পথে বিপর্যয়ই তাঁর সহায় হল। দলের ভিতরে-বাইরে সকলে মানছেন, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করতে পারেন বিজয়ন।
মানছেন তাঁর পশ্চিমবঙ্গের কমরেডরাও। বলা ভাল, মানতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রকাশ কারাটের ঘনিষ্ঠ বিজয়নের সঙ্গে সিপিএম-এর ‘বেঙ্গল লবি’র সম্পর্ক মধুর, এমন দাবি কেউ করবেন না। বস্তুত, কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোর ‘বেঙ্গল লাইন’ যাঁদের আপত্তিতে ঘেঁটে গেল শেষ অবধি, বিজয়ন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এই দফায় সীতারাম ইয়েচুরির রাজ্যসভায় যাওয়াও ভেস্তে গিয়েছিল তাঁদেরই আপত্তিতে। কোভিড-১৯ সামলাতে সেই বিজয়নের ‘কেরল মডেল’-এর সাফল্যর জয়গান করতে হচ্ছে বইকি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটকে। শিবরাত্রির সলতের মতো শুধু কেরলই রয়েছে যে।
এবং আশ্চর্য, যে কংগ্রেসের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে দলের হাত মেলানো নিয়ে তাঁর সুতীব্র আপত্তি ছিল— নিজের রাজ্যে কংগ্রেস তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ বলে— সেই কংগ্রেসকেই, সেই নিজের রাজ্যেই, পাশে টেনে নিলেন বিজয়ন। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে তাঁর পাশে হাঁটলেন রমেশ চেন্নিতালা, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। কোভিড-১৯’এর সময় নিজেদের এমপি-ল্যাডের টাকা থেকে কংগ্রেস সাংসদরা পিপিই কিনে দিলেন তাঁকে। রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাজ্যের স্বার্থ? না কি, নিজেকে দলের ঊর্ধ্বে রাজ্যের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সফল হলেন পিনারাই বিজয়ন? এটাই বোধ হয় সবচেয়ে বড় যুদ্ধজয় তাঁর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy