দাপট কাহাকে বলে, নরেন্দ্র মোদী জানেন। ভারতের মতো দেশকে ঘরবন্দি করিয়া রাখিবার আদেশ ঘোষণায়, নাগরিকদের নানাবিধ ‘টাস্ক’ দিবার প্রক্রিয়ায় কিংবা হাত জোড় করিয়া সহযোগিতার অনুরোধ জানাইতে গিয়াও তাঁহাদের ‘অনুশাসিত সিপাহি’ বলিবার সিদ্ধান্তে দাপটের কোনও অভাব ছিল না। কিন্ত দাপট আর সাহস এক নহে, এই প্রাথমিক সত্যটি প্রধানমন্ত্রী জানেন তো? না জানিলে বিপদ। বড় বিপদ। কারণ, ভয়ানক বিপর্যয়ের সম্মুখীন ভারতীয় অর্থনীতি তাঁহার নিকট, তাঁহার সরকারের নিকট যে বস্তুটি চাহিতেছে, তাহা দাপট নহে, সাহস। যে সাহস সত্যকারের নেতৃত্বের অপরিহার্য এবং অমোঘ অভিজ্ঞান। যে সাহস কঠিনতম সঙ্কটের মধ্যে দাঁড়াইয়া দৃঢ় প্রত্যয়ে উত্তরণের দুর্গম পথে অগ্রবর্তী হইতে পারে। এখনও, জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর চতুর্থ ভাষণের পরেও, সেই সাহসের কোনও পরিচয় মিলিল না।
বিশ্ব অর্থনীতি বাস্তবিকই কঠিনতম সঙ্কটে। লকডাউন ফুরাইলেও, এমনকি সংক্রমণের তীব্রতা কমিলেও, সেই সঙ্কট অ-নিবার্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অধিকাংশ ইউরোপসহ বিশ্ব অর্থনীতি শয্যা লইয়াছে, চিন উঠিবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু এখনও বিপন্মুক্ত নহে। এই সার্বিক অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া ভারতীয় অর্থনীতিকে তাহার বিপর্যয়ের মোকাবিলা করিতে হইবে। একাধিক স্তরে। প্রথম কাজ অবশ্যই অগণিত দরিদ্র, অসহায়, কর্মহীন মানুষের জীবনধারণের ব্যবস্থা। অভিবাসী শ্রমিক বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী ও ‘স্বনিযুক্ত’ উদ্যোগী হইতে শুরু করিয়া খেতমজুর, ক্ষুদ্র চাষি, মৎস্যজীবী ইত্যাদি বহুবিধ বর্গের শ্রমজীবী এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো তাঁহাদের একাংশের দৈনন্দিন কাজ কিছুটা শুরু হইবে। কেন্দ্রীয় সরকার সেই প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা জানাইয়াছে, রাজ্যে রাজ্যে তাহার রূপায়ণের প্রস্ততি চলিতেছে। অত্যন্ত জরুরি উদ্যোগ।
কিন্তু যথেষ্ট নহে। অর্থনীতির স্বাভাবিক শক্তি এই মুহূর্তে বিনষ্ট। এমনকি সংগঠিত শিল্প-উদ্যোগেও বিনিয়োগের স্তব্ধ স্রোতে স্বতঃস্ফূর্ত গতি সঞ্চারের সম্ভাবনা কার্যত শূন্য। এমন সময়ে রাষ্ট্রের নেতৃত্ব এবং উদ্যমের কোনও বিকল্প নাই, ইতিহাসে বারংবার তাহা প্রমাণিত হইয়াছে। রাষ্ট্রের কর্তব্য দুইটি। এক, অসহায় নাগরিকদের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণের বন্দোবস্ত করা। দুই, শিল্পবাণিজ্যের পরিচালকরা যাহাতে কাজ চালাইয়া যাইতে পারেন তাহার ব্যবস্থা করা। বহু সুস্থ সবল ব্যবসায়িক সংস্থার ভান্ডারেও ইতিমধ্যেই মা ভবানী অধিষ্ঠান করিতেছেন, অথবা শীঘ্রই করিবেন। বাজার ছন্দে ফিরিলেও অনেকে ‘ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল’ বা নির্বাহী মূলধনের অভাবে ব্যবসা চালাইতে পারিবেন না। তাহার সামগ্রিক প্রভাব পড়িবে বাজারের চাহিদাতেও। সরকারের দায়িত্ব— প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে যাহাতে অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ব্যাহত না হয়, তাহা নিশ্চিত করা। সে জন্য ব্যাঙ্কগুলিকে অংশত কাজে লাগানো আবশ্যক। পাশাপাশি, পরিকাঠামো, বিশেষত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো সম্প্রসারণের কাজে বিপুল সরকারি বিনিয়োগের প্রয়োজন। এই সমস্ত প্রয়োজন মিটাইতেই সরকারকে খরচ করিতে হইবে। তাহার সংস্থানের জন্য বাজেটের ঘাটতি কিছুটা না বাড়াইয়া উপায় নাই। অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা প্রায় সমস্বরে বলিতেছেন, এমন সঙ্কটে ঘাটতি কিছু দূর অবধি বাড়িলে বাড়িবে। তাহার জন্য ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের মৌলিক ধর্ম পরিত্যাগ করিবার প্রয়োজন নাই। প্রথমত, অর্থনীতিকে ছন্দে ফিরাইতে পারিলে বিশেষ ব্যয়ের চাহিদা কমিবে। দ্বিতীয়ত, সরকারের বাজেট হইতে অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাতিল করিবারও সুযোগ আছে। যথা, দিল্লিতে ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’ সাজাইবার ব্যয়। শেষ বিচারে, অভাব অর্থের নহে, অভাব বিচারবুদ্ধির। অভাব নূতন করিয়া ভাবিবার সাহসের। মোদী জমানায় রাজধানীতে এই গুণগুলি দুর্লভ। দুশ্চিন্তার কথা।
আরও পড়ুন: তবলিগি জামাতের ইতিবৃত্ত
আরও পড়ুন: এখন বিনিয়োগ করবে কে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy