ছোটবেলায় শুনেছিলাম, নস্ট্রাডামুস নাকি ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন, একবিংশ শতকে বিশ্বব্যাপী সঙ্কটের কথা। সেই সময়ে ভারতে নাকি ‘চেরিয়ান’ নামে এক মহাপুরুষের উত্থান হবে, যার সামনে মাথা নত করবে সমগ্র বিশ্ব। ক’দিন আগে শুনলাম আজকাল সেই উদ্ধারকর্তার নাম হয়ে গিয়েছে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী! বিশ্বাসপ্রবণ ভারতীয়দের দোষ দেওয়া মুশকিল, ইতিহাস বলছে, জাতীয় বিপর্যয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা ত্রাতা তৈরি এবং সাধারণের মনে অবতার নির্মাণ নতুন ঘটনা নয়। সাধারণ মানুষ দুর্যোগের সময় যে সুরক্ষা খুঁজবেন, সেটাই স্বাভাবিক। সেই সুরক্ষা পান না, সেটাও প্রায় স্বাভাবিক। সুতরাং তখন তাঁরা বিশ্বাসের উপর ভর দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন, অলৌকিকতার বিশ্বাস।
সত্যিই কি কোনও বড় রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের আগের সঙ্কেত, সঙ্ঘর্ষ এবং সঙ্কটগুলি এক রকমের হয়? ভারতের ইতিহাস ঘাঁটলে এখনকার সঙ্গে খানিকটা মিল পাওয়াই যায় দেশভাগের দশকটির। তখনও রাখঢাক না করে ধর্মের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল জাতির ও মানুষের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বকে। বলা হয়েছিল, কোন ধর্মের মানুষ কোন দেশে আশ্রয় পাওয়ার যোগ্য হবেন। ওটা আসলে ছিল ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র তৈরির তুরুপের তাস। মানুষকে বিভাজনের অস্ত্র। কোন শর্ত পূরণ হলে রাষ্ট্র তাকে আগলে রাখবে, আর কিসের ভিত্তিতে সীমানার বাইরে গলাধাক্কা দিতে পারে, নির্দিষ্ট করে তা-ও বলা হয়েছিল। আশ্চর্য, ঠিক এই একই ধরনের শর্তাধীন ধর্মীয় আনুগত্যের দ্বারা মানুষের মধ্যে বিভাজনের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি এই ক’দিন আগেও আমাদের দেশে দেখেছি।
অর্থনীতি বিষয়েও শ্রেণিগত বৈষম্যের প্রেক্ষিতে তখনকার সঙ্গে এখনকার সময়ের বেশ মিল। সে সময়ে শাসক দলের সঙ্গে অর্থনৈতিক লাভ-লোকসান ও লেনদেনে যুক্ত ছিলেন শিল্পপতিরা। তাঁরাই ব্রিটিশ শাসকের সঙ্গে দড়ি টানাটানি করতেন— পাউন্ড-স্টার্লিংয়ের দাম ভারতীয় মুদ্রার নিরিখে কী হবে তা নিয়ে। তাঁরাই লাভবান হয়েছিলেন সরকারি আনুকূল্যে। সেই পথ বেয়ে এসেছেন তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরিরা। এখনও কিছু গোষ্ঠী বিভিন্ন রকমের সুবিধা পাচ্ছে। বড়লোকেরা দেশি-বিদেশি অর্থনীতির সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন, গরিব মানুষ শেষ সম্বলটুকুও হারাচ্ছেন।
আরও পড়ুন: কবি-রাজ রবীন্দ্রনাথ: পাঁচন দাওয়াই কি এখন করোনায় কাজ করবে?
সামাজিক সুরক্ষাই আসলে কোনও রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় শর্ত। তার জন্য দরকার সরকারের সদিচ্ছা এবং দায়বদ্ধতার উপর জনসাধারণের আপাত আস্থা। স্বাধীনতার আগে, বিশেষ করে ১৯৪০-এর দশকের প্রায় শুরু থেকেই দুটো বিশেষ ঘটনা মানুষের এই আস্থা, বিশ্বাস ও বহু বছরের অর্জিত সামাজিক মূল্যবোধকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। কী সেই ঘটনা, যা সাধারণ মানুষকে অল্প সময়ের জন্য হলেও খানিকটা ‘সাম্প্রদায়িক’ করে তুলেছিল? উত্তর: ক্ষুধা এবং আর অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্কট। আর একটু বিস্তারে বললে, ১৯৪৩-এর মহামারি ও ১৯৪৬-এর দাঙ্গা। ইতিহাস কিন্তু বার বার মানবসভ্যতাকে শিখিয়েছে যে এই দুটি এমনই বিষয় যাতে মানুষের পিঠ থেকে যায় দেওয়ালে। তাই আর যাই হোক এই ধরনের আগুন নিয়ে খেলা না করাই ভাল। কিন্তু পৃথিবীতে কত জন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীই বা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছেন?
রাজনৈতিক দল ও নেতাদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি সে দিনও যেমন, আজও তেমন। তাই তাঁরা আজও ঠিক এক রকম থেকে গিয়েছেন, যাঁরা সব সঙ্কটে রাষ্ট্রের পরীক্ষার ঘুঁটি হতে বাধ্য হন। শুধু সাধারণ কৃষক, শ্রমিক নন, এর মধ্যে আছেন বিভিন্ন পেশার নানা রকম মানুষ। বাস্তবিক, এঁদের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি, যে ছবি আমরা তখনও দেখতাম, আজও তাই দেখছি। ৭৩ বছর আগে ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রনেতারা যখন ক্ষমতার খেলায় মেতে, প্রথমে সাধারণ মানুষকে তাঁদের জন্য তৈরি রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরু হয়ে থাকার সুবিধার কথা বুঝিয়েছিলেন, আর দেশভাগের কিছু পরে সাধারণ মানুষের বিরাট ঢল দেখে ভয় পেয়ে বিভিন্ন আইন আর পাসপোর্ট-ভিসা চালু করে তাঁদের আসা-যাওয়া আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন, আজও আমাদের নেতারা প্রায় ঠিক সেই কাজই করছেন। তাই আমরা দেখলাম, বিশাল সংখ্যক গৃহমুখী মানুষের ঢল নামল ভারতের রাজপথে, বাংলাদেশের নদীপথে, দক্ষিণ-পূর্বের রাজ্যগুলোয়, এমনকি পাহাড় পেরিয়েও।
আরও পড়ুন: চিকিৎসা করাতে গিয়ে ভিন্ রাজ্যে আটকে, বাড়ি ফেরানোর আর্তি এঁদের সকলেরই
কী রকম চমকে ওঠার মতো মিল, না? আমরা শুনেছি, গত কয়েক দিনে না খেয়ে বা বিশ্রাম ছাড়া শয়ে শয়ে কিলোমিটার হেঁটে, করোনার থাবা গায়ে পড়ার আগেই মারা গিয়েছেন কত মানুষ। শাশুড়ির মুখে শুনেছিলাম যে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পালিয়ে আসার পথে কলেরায় মৃত্যু হয়েছিল ওঁর ছোট বোনের। নৌকা থেকে ওঁরা নদীতে ছুঁড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তার নিথর কচি দেহ। কে জানে, কোন বিশ্বাসে ভর রেখে সেই সব কঠিন সময় পার হয়েছিলেন তাঁরা, কাকে তাঁরা ত্রাতা ভেবেছিলেন, কিংবা কাউকে ভেবেছিলেন কি না। তবে ইতিহাস যে ফিরে ফিরে আসে, সেই প্রবাদটায় কিন্তু কোনও ভুল নেই।
ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy