গোটা দেশেই অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াইটি শুধুমাত্র একটি রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সীমাবদ্ধ নহে, সামাজিক পরিসরেও বিপুল বাধার মোকাবিলা করিতে হইতেছে। ছবি: এএফপি।
পশ্চিমবঙ্গে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার সামান্য হইলেও কমিয়াছে। বহু উদ্বেগের মধ্যে এই সংবাদটি আশ্বস্ত করিবার মতো। সংক্রমিত ব্যক্তির মৃত্যু প্রতিরোধ কোভিড-১৯ মোকাবিলার একটি প্রধান কৌশল। রোগ মহামারির আকার লইয়াছে, অতএব সংক্রমণের বিস্তার রোধ করিবার সকল প্রকার চেষ্টার পরেও সংক্রমিতের সংখ্যা আরও কিছু দিন বাড়িবে, এমনই প্রত্যাশিত। সংক্রমণ বাড়িলেও, রোগের মারণক্ষমতা কমাইতে পারিলে ক্ষতি কমিবে। এই ক্ষেত্রে সাফল্যের বৃহত্তম প্রমাণটি মিলিবে কেরলে। সেই রাজ্যেই করোনাভাইরাস সর্বাগ্রে তাহার করাল রূপ প্রকাশ করিয়াছিল। কিন্তু সরকার ও নাগরিকদের তৎপরতার কারণে কেরলে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা এখনও অবধি মাত্র ১৭। পশ্চিমবঙ্গে কোভিড-১৯’এ মৃত্যুর হার ছিল পাঁচ শতাংশ, কমিয়া দাঁড়াইয়াছে ৪.৬ শতাংশে। এখনও অবধি হারটি দেশের জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশি, আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতেও বেশি। সুতরাং, রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা শিথিল করিবার প্রশ্নই নাই। তবে একই সঙ্গে এই তথ্যটি স্বস্তিদায়কও বটে যে অতিমারি নিয়ন্ত্রণের আশা দেখা দিয়াছে। আরও একটি কথা। মৃত্যুহারে হেরফের যে রোগের মারণক্ষমতার হেরফের বুঝাইতেছে, এমন ভাবিলে ভুল হইতে পারে। ইহা সংক্রমিতের নমুনা পরীক্ষা বিষয়ক নীতির ফল। যদি সংক্রমণের হার বুঝিতে সাধারণ নাগরিকের মধ্যে অধিক সংখ্যায় নমুনা পরীক্ষা করা হয়, তাহা হইলে সংক্রমণের হারও অধিক মিলিবে, ফলে অঙ্কের নিয়মে মৃত্যুহার কমিবে।
গোটা দেশেই অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াইটি শুধুমাত্র একটি রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সীমাবদ্ধ নহে, সামাজিক পরিসরেও বিপুল বাধার মোকাবিলা করিতে হইতেছে। এই রাজ্যও ব্যতিক্রম নহে। ভারতে কোভিড-১৯’আক্রান্ত হইলে কার্যত একঘরে হইবার জোগাড় হইতেছে। প্রতিবেশীরা পাড়াছাড়া করিতেছেন, আত্মীয়স্বজন মুখ ফিরাইয়া লইতেছেন। রোগে আক্রান্ত হইবার ভয়টি নিতান্ত স্বাভাবিক, কিন্তু সহমর্মিতার এমন প্রকট অভাবকেও ‘স্বাভাবিক’ বলিলে যে সমাজের ছবিটি ভাসিয়া উঠিবে, তাহা ভয়ঙ্কর। মুখ ফিরাইয়া লইবার এই অস্বাভাবিকতা হইতে সমাজকে উত্তীর্ণ হইতেই হইবে। নচেৎ, তাহার পরিণাম সমাজের পক্ষেও মারাত্মক। আশঙ্কা হয়, সামাজিক কলঙ্কের ভয়েই অনেকে রোগলক্ষণ দেখা দিবার পরও তাহা লুকাইতে মরিয়া হইতেছেন। তাহাতে সংক্রমণের গতি বাড়িতেছে, রোগও মারাত্মকতর হইতেছে। গোটা দুনিয়ায় যখন কোভিড-১৯’এ মহিলাদের মৃত্যুর হার তুলনায় কম, ভারতে তখন ছবিটি বিপরীত। হয়তো ইহার পিছনেও সামাজিক অসংবেদনশীলতা কাজ করিতেছে। জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষিতে এ দেশে মহিলারা সর্বদাই পিছাইয়া থাকেন, কারণ পরিবারের পরিসরে তাঁহাদের গুরুত্ব এবং দাম কম। অতিমারিতে আক্রান্ত হইলে যদি সামাজিক মূল্য চুকাইতে হয়, তবে মহিলাদের রোগাক্রান্ত হইবার কথাটি আরও বেশি করিয়া চাপিয়া রাখা হইবে, এই সম্ভাবনাটি অতি দুঃখজনক হইলেও উড়াইয়া দিবার নহে।
অর্থাৎ, অতিমারি নিয়ন্ত্রণে সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, ব্যক্তির এবং সমাজের দায়িত্বগুলিও অনস্বীকার্য। সরকারের কাজ হাসপাতালগুলিকে নিরাপদ করিয়া তোলা, মানুষের মধ্যে রোগ সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি। অন্য দিকে, সমাজের দায়িত্ব হইল সহমর্মিতার বোধটিকে মরিতে না দেওয়া। কেহ কোভিড-১৯’এ আক্রান্ত হইলে যে তাঁহার অধিকতর সাহায্য প্রয়োজন, এই কথাটি বুঝিতে স্বাভাবিক মানবিকতাই যথেষ্ট। নিজেকে বিলক্ষণ নিরাপদ রাখিতে হইবে, কিন্তু তাহার নির্দিষ্ট পন্থা আছে। রোগাক্রান্তকে একঘরে করিয়া এই যুদ্ধে জেতা অসম্ভব। রোগ ব্যতীত এই যুদ্ধে দ্বিতীয় কোনও শত্রু নাই, ইহা ভুলিলে চলিবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy