সোয়াব টেস্টের জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে এক মহিলার।—ছবি রয়টার্স।
কোভিড অতিমারি সঙ্কটটিকে প্রকৃত অর্থেই একটি ‘জাতীয় বিপর্যয়’ বলা চলে। আমাদের দেশে যে কোনও বিপর্যয় সাধারণত কয়েকটি অঞ্চলে সীমিত থাকলেও সারা দেশের আবেগকে নাড়া দেয়। ঘূর্ণিঝড় থেকে ভূমিকম্প, সন্ত্রাসবাদী হামলা কিংবা যুদ্ধ— এই সব ক্ষেত্রেই আমরা এর ইঙ্গিত পাই। কিন্তু কোভিড অতিমারি সঙ্কটটির চরিত্র একটু আলাদা। কাশ্মীর থেকে কেরল, উত্তর পূর্ব ভারত থেকে পশ্চিম উপকূল— আমরা দেখেছি সব জায়গাতেই এই অতিমারি দারুণ ভাবে উপস্থিত এবং এর মোকাবিলায় প্রতিটি স্থানীয় প্রশাসন খুবই সক্রিয়।
একটি মহামারি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিগত ভূমিকা থাকে ঠিকই, তবে স্বাস্থ্যগত পরিকাঠামো তৈরি কিংবা পরিষেবা প্রদানের ভার বহন করে রাজ্যগুলিই। প্রতিটি রাজ্যের নির্দিষ্ট সমস্যাগুলিও আলাদা। সুতরাং, রাজ্যগুলি নিজের মতো করে এই সঙ্কটের মোকাবিলা করছে। তারা পরস্পরের কাছ থেকেও শিখছে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর প্রকৃত স্বরূপ আমরা এখন চাক্ষুষ করতে পারছি। আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমি যে উদাহরণগুলো দেব, সেগুলি আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ এবং অবশ্যই বাংলায় কাজ করতে গিয়েই এই অভিজ্ঞতা আমি লাভ করেছি।
কথা না বাড়িয়ে আমি এখানে তুলে ধরছি ৯টি কেস স্টাডির কথা। ৯ কেন? ধরা যাক, ৯ একটা জনপ্রিয় সংখ্যা।
১. স্বাস্থ্য বিমা
পথ প্রদর্শক: বাংলা
লকডাউনের ফলে আমরা যখন সকলে ঘরবন্দি, তখন অনেকেই কোভিড অতিমারির বিরুদ্ধে সামনের সারি থেকে লড়ছেন। ঠিক ধরেছেন, এঁরা হলেন স্বাস্থ্যকর্মী, জরুরি ও অপরিহার্য পরিষেবা প্রদানকারী কর্মীরা। আমাদের দায়িত্ব এই সব মানুষের খেয়াল রাখা। বাংলাই প্রথম রাজ্য, যে এই বীর সাহসী যোদ্ধা এবং তাঁদের পরিবারের জন্য অতিরিক্ত স্বাস্থ্য বিমার কথা ঘোষণা করে।
আরও পড়ুন: একুশ শতকে মহামারির আক্রমণে বিপন্ন দেশ, মহাদেশ, মানবজাতি
এই বিমা সম্পর্কে প্রথমে বলা হয়েছিল ৫ লক্ষ টাকার কভারেজ, যা পরে বাড়িয়ে ১০ লক্ষ করা হয়। এই বিমা ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, সাফাইকর্মী, আশা কর্মী ও পুলিশ কর্মীদের প্রদান করা হবে। তাঁরা রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার বা বেসরকারি ক্ষেত্রের কর্মচারী হতে পারেন, কিন্তু অবশ্যই বাংলায় কর্মরত হতে হবে।
২. স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর প্রতুলতা
পথ প্রদর্শক: ছত্তীসগড় ও বাংলা
করোনা ভাইরাস ধীরে ধীরে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। ছোট শহর এবং গ্রামের লোকেদের চিকিত্সার জন্য বড় বড় শহরে যাওয়া সম্ভব নয়। লকডাউন এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয় এমন ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে।
এই সমস্যার সমাধান হিসেবে ছত্তীসগড় রাজ্যের ২৮টি জেলাতেই বিভিন্ন হাসপাতালে ১০০টি শয্যা কোভিড আক্রান্তদের জন্য নির্ধারিত হয়েছে। এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কারণ, ছত্তীসগড় মূলত গ্রামীণ রাজ্য, যেখানে সাধারণ মানুষকে অনেকটা পথ অতিক্রম করে হাসপাতাল যেতে হয়। বাংলায় ২২টি জেলায় একটি করে হাসপাতাল কোভিড আক্রান্তদের জন্য নির্ধারিত করেছে রাজ্য সরকার। বেসরকারি হাসপাতালও সরকারকে সাহায্য করছে এই উদ্যোগে।
৩. প্রান্তিক মানুষের কল্যাণ
পথ প্রদর্শক: ছত্তীসগড়, দিল্লি ও বাংলা
আমাদের দেশের বহু মানুষের কাছে দু'বেলা পেট ভরে খাওয়াটাই একটা চ্যালেঞ্জ। দিনমজুর ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের আয় লকডাউনের ফলে বন্ধ। তাঁদের সুবিধার্থে, ছত্তীসগড়ে যাঁদের রেশন কার্ড আছে তাঁদের এপ্রিল ও মে মাসের বরাদ্দ চাল এক দফায় বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে। দিল্লিতে সরকারি আশ্রয়গুলিতে বিনামূল্যে দু'বেলার খাবার দেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন: আরও কঠোর, আরও দ্রুত, আরও বেশি: চিনের থেকে কী শিখতে হবে ভারতকে
বাংলায় সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বিনামূল্যে ছ'মাসের রেশন দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে মিড-ডে মিল পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এই উদ্যোগটি কেরলেও নেওয়া হয়েছে। রেশন কার্ড না থাকলেও খাবার প্রদান করা হচ্ছে, বিশেষ করে গৃহহীন মানুষ ও পরিযায়ী শ্রমিকদের।
৪. সামাজিক সুরক্ষা
পথ প্রদর্শক: কর্নাটক, বাংলা, ওড়িশা, দিল্লি
যে সব মানুষের আয় সীমিত বা কোনও আয় নেই, তাঁদের অন্ন সংস্থান না হয় সরকার করছে। কিন্তু তাঁদের সংসার চলবে কি করে? তাঁদের জন্য কর্নাটক ও বাংলায় রাজ্য সরকার বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে বরাদ্দ ভাতাগুলি দু'মাসের অগ্রিম প্রদান করেছে। ওড়িশা সরকার তিন মাসের অগ্রিম সামাজিক সুরক্ষা পেনশন প্রদান করছে। দিল্লি সরকার বিধবা, বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষ ও প্রবীণ নাগরিকদের ভাতা দ্বিগুণ করেছে।
৫. চলার নামই জীবন
পথ প্রদর্শক: দিল্লি
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অটোরিকশা, ই-রিকশা এবং ট্যাক্সি ড্রাইভাররা যে যানবাহন চালান, তার মালিক তাঁরা নিজেই। তাঁদের দৈনিক উপার্জনের ভিত্তিতেই তাঁদের সংসার চলে। এবং এই দৈনিক আয় থেকেই তাঁদের গাড়ির ইএমআই প্রদান করতে হয়। বড় শহরগুলিতে অৰ্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং গণ-পরিবহণ এঁদের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তাই, লকডাউনের পর এই মানুষগুলি যাতে কাজে ফিরতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। সেই লক্ষ্যে, দিল্লি সরকার প্রত্যেক চালককে ৫০০০ টাকা প্রদান করছে।
৬. অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরতদের সুরক্ষা
পথ প্রদর্শক: রাজস্থান, ওড়িশা, বাংলা
অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের বিশেষ করে দিনমজুরদের মতো শ্রমিকদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নেই। না আছে পিএফ, না আছে পেনশন। লকডাউনের ফলে তাঁরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত। ওড়িশা সরকার এমন ২২ লক্ষ শ্রমিককে ১,৫০০ টাকা করে প্রদান করছে। দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারগুলিকে ১,০০০ টাকা করে প্রদান করছে রাজস্থান সরকার। বাংলায় একটি নতুন প্রকল্প চালু হয়েছে যার নাম ‘প্রচেষ্টা’। এর মাধ্যমে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের ১,০০০ টাকা করে প্রদান করা হচ্ছে।
৭. অতিথি শ্রমিকদের হিতসাধন
পথ প্রদর্শক: মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ু
লকডাউন ঘোষণার পর প্রথম ৪৮ ঘণ্টা ছিল অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। ব্যবস্থাপনায় খামতি ছিল। বাংলার মতো রাজ্য, যেখান থেকে অনেক শ্রমিক ভিন্ রাজ্যে কাজে যান, সোশ্যাল মিডিয়া ও ফোনের মাধ্যমে সেই সব রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করে। অতিথি শ্রমিকদের হিতসাধনে মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ু সবচেয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। তামিলনাড়ুতে শুধু রাজ্য সরকার নয়, বিরোধী দল ডিএমকে-ও দলের কর্মীদের এই কাজে লাগায়। বাংলায় আটকে পড়া ওড়িয়া শ্রমিকদের সাহায্যের জন্য ওড়িশা সরকার বাংলার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এবং ওড়িশা সরকার সেখানে কর্মরত বাঙালি শ্রমিকদের খেয়াল রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই উদ্যোগগুলি প্রশংসার দাবি রাখে।
আরও পড়ুন: অদ্ভুত একটা দুর্ভিক্ষ এগিয়ে আসছে, গরিব মানুষের হাতে টাকা দিতে হবে এখনই
৮. নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান
পথ প্রদর্শক: কেরল, মহারাষ্ট্র, বাংলা
কেরলে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর কিট (যার মূল্য ১০০০ টাকা) বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। মহারাষ্ট্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান (যেমন মুদির দোকান বা ওষুধের দোকান) ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। দিল্লিতেও একই ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ যাতে অব্যাহত থাকে, তার জন্য উচ্চ পর্যায়ের আধিকারিকদের তত্ত্বাবধানে সেল তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় স্তরে এর দেখাশোনা করছে পুলিশ। বিশেষ করে প্রবীণ নাগরিকদের কাছে ওষুধ সরবরাহের কাজ করছেন তাঁরা।
৯. সচেতনতার প্রসার
পথ প্রদর্শক: কাকে ছেড়ে কার কথা বলি
প্রত্যেকটি রাজ্য করোনা মোকাবিলায় কী করা উচিত, কি করা উচিত নয়, তার একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এই ব্যাপারে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। তিনি নিয়মিত মানুষের জন্য বার্তা দিচ্ছেন, সাংবাদিক বৈঠক করছেন, এবং দৈনন্দিন জীবনে আমরা কী ভাবে সতর্ক থাকতে পারি, তার বাস্তবসম্মত উদাহরণ দিচ্ছেন। সরজমিনে তিনি তদারকি করছেন, কখনও বাজারে, কখনও হাসপাতালে। একটি বাজারে তো তিনি নিজে হাতে রাস্তার উপর চক দিয়ে গোল্লা এঁকে মানুষকে বোঝালেন, কী ভাবে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সেই ঘটনার ভিডিয়োটিও ভাইরাল হয়েছে।
বিভিন্ন রাজ্য যে পদক্ষেপগুলি নিচ্ছে, সেগুলি আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর পরিচয়। এটিই ভারতবর্ষের চালিকাশক্তি। কেন্দ্রের উচিত এই উদ্যোগগুলি থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং জাতীয় স্তরে সেগুলি চালু করা। এখন বুক চাপড়ে আত্মতুষ্টি ঘোষণার সময় নয়। প্রত্যেকটি রাজ্য সাধ্য মতো চেষ্টা করছে। আমাদের একসঙ্গেই লড়তে হবে।
(লেখক সাংসদ, রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের দলনেতা। মতামত নিজস্ব)
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy