—ফাইল চিত্র।
আজকাল এই হয়েছে এক ফ্যাচাং। সব কিছুতেই একটা পয়েন্ট ‘ও’ যোগ করে দেওয়া। আর সেই হিসাবে আমরা পা দিলাম লকডাউন ৪.০-তে।
প্রধানমন্ত্রীও এই নেট দুনিয়ার সূচক তৈরির মোহ থেকে মুক্ত নন। তিনি রাজনীতির মানুষ। তাই জানেন সাধারণ মানুষ অঙ্কের জটিলতায় মাথা ঘামাবেন না। সেই কারণেই তিনি ঘোষণা করেছেন ২০ লক্ষ কোটি টাকার সহায়তা প্যাকেজ। এবং মানুষের মনে দাগ দিয়ে ২০-র সঙ্গে ২০-র ছন্দ মিলিয়ে দিয়েছেন। যাতে মানুষ মনে রাখেন। কারণ সালটা যে ২০২০।
কিন্তু এটা তো অঙ্কই! এবং আদতে পাটিগণিত। এবং তা বলছে— কেন্দ্রীয় সরকার কোভিডের মোকাবিলায় যা করবেন বলেছেন আর যা করছেন তার মধ্যে ফারাক বিস্তর। মাথায় রাখতে হবে, সরকারকে খরচ করতে হয় কোষাগার থেকেই, আর তার প্রতিটি পয়সা খরচের জন্য সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয় কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলিকে। আর তাই সরকারের হিসাবের খাতাই বলে দেবে কেন্দ্র আসলে কত টাকা খরচ করছে। তাই অঙ্কটা দেখা যাক।
আরও পড়ুন: কলকাতা বন্দর হাসপাতালে করোনার থাবা, আক্রান্ত ৯, বন্ধ প্যাথোলজি বিভাগ
কেন্দ্রীয় সরকার চলতি বছরে ৩০ লক্ষ ৪২ হাজার ২৩০ কোটি টাকা খরচ করার প্রস্তাব রেখেছে। ঋণ বাদে সরকারের আয়ের আশা ছিল ২২ লক্ষ ৪৫ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। আর আয় ও ব্যয়ের ফারাক মেটাতে ঋণ বাবদ ৭ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা তোলার পরিকল্পনা ছিল সরকারের।
কিন্তু করোনা সব ঘেঁটে দেওয়ায় আয়ের অঙ্কটাও ঘেঁটে গিয়েছে। বাজারের চাকা করোনার কাদায় আটকে গিয়েছে। বিক্রি না হলে কর বাবদ আয় নেই। কিন্তু দেশ চালু রাখতে গেলে সরকারকে তো খরচ করতেই হবে। তাই সরকার তার ঋণের দায় ১২ লক্ষ কোটি টাকায় তুলেছে। অর্থাৎ সরকারের খাতায় ঋণ বাড়ছে ৪.২ লক্ষ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ সরকার মনে করছে বাজার বসে যাওয়ায় বা কোভিড লড়াইয়ে খরচ বাড়ায় তার আয়ের ঘাটতি এ রকমই বাড়তে পারে।
অর্থাৎ যদি ধরেও নিই যে অর্থনীতি ফিরে এল নিজের ছন্দে এবং সরকারের আয়ের কোনও ক্ষতিই হল না, তা হলে এই ৪.২ লক্ষ কোটি টাকাই হবে কোভিড খাতে খরচ। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়! কারণ উৎপাদন তলানিতে। তাই আয় কমবে। এবং কোভিড বাবদ কোষাগার থেকে আসল খরচটা ৪ লক্ষ কোটি টাকার অনেক কমই হবে। ঠিক কতটা, তা এখনও অনুমান। কিন্তু অনেকেই বলছেন তা হবে ২ লক্ষ কোটি টাকার আশেপাশে। অর্থাৎ জিডিপি-র ১ শতাংশের মতো।
সরকারের আয় আমাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া কর, এটা মাথায় রাখতে হবে। সরকার কিন্তু আমাদের করের দায় থেকে মুক্তি দেয়নি। অর্থাৎ নিজের রোজগারের রাস্তায় কোনও ভাবে আপোস করেনি কেন্দ্রীয় সরকার। যেটা করেছে তা হল করের দায় পিছিয়ে দেওয়া। আজ না দিয়ে আগামী কাল আমাকে আর আপনাকে করের দায় মেটাতেই হবে।
বাজার চালাতে হলে আমার আপনার হাতে খরচের টাকা থাকতে হবে। কিন্তু যেখানে বহু মানুষের রোজগারের রাস্তাই বন্ধ সেখানে খরচ হবে কোথা থেকে। সরকারের সোজা পথ, প্রভিডেন্ট ফান্ডে আপনার দায় কমানো। মূল রোজগারের উপর আপনি দিতেন ১২ শতাংশ, এখন দেবেন ১০ শতাংশ। এতে নাকি মানুষের খরচ করার ক্ষমতা বাড়বে!
সরকার যেটা বললেন না, সেটা হলে নাগরিক যখন সরকারের বদান্যতার প্রত্যাশী তখন সরকার নিজের আয়ের ব্যবস্থা করল আপনার সামাজিক সুরক্ষার বিনিময়ে। সাধারণ চাকুরিজীবীর অবসরের পরের ভরসা ওই প্রভিডেন্ট ফান্ডের কয়েকটি টাকা। তার দায় কমলে কিন্তু আসলে চাপ আসবে অবসরের পরে। সঞ্চয় কমে। আর যে মুহূর্তে আপনার হাতে আয় হিসাবে ওই ২ শতাংশ আসবে, সরকার তার থেকে আয়কর কাটবে আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হারেই। লাভ কার? সরকারেরই। আর আখেরে ক্ষতি কিন্তু আপনারই।
দেশের জন্য দশকে ক্ষতি স্বীকার করতেই হয়। আমরা তা জানি। কিন্তু এই রকম পরিস্থিতিতে সরকারকেও তো ঝাঁপাতে হবে বাজার বাঁচাতে! কিন্তু তার কোনও লক্ষণই এখনও দেখা যাচ্ছে না কেন্দ্রীয় সরকারের খরচের হিসাবে। ওই ২০ লক্ষ কোটি টাকার অঙ্কটা মিলতেই চাইছে না। বাজারে চাহিদা বাড়াতে হলে সরকারের খরচ বাড়াতে হবে। কারণ বাজারে সরকারই সব থেকে বড় ক্রেতা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরকারের কোষাগারের অঙ্কে তো তা পাওয়া যাচ্ছে না!
আরও পড়ুন: ২১ মে থেকে ‘এ-জোন’ বাদে রাজ্যের সর্বত্র বড় দোকান খুলবে
পাঁচ দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে তাই অর্থমন্ত্রী ও রাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে হয়েছে— কত টাকা খরচ হচ্ছে তার থেকেও বেশি নজর দেওয়া উচিত খরচের অভিমুখটা বোঝা। এটি যদিও দুজনেই ইংরাজিতে বলেছেন। অনুরাগ ঠাকুরও। যদিও অনুরাগবাবুর দায় ছিল হিন্দিতে সবাইকে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য বুঝিয়ে বলা। এটা নিয়ে অন্য প্রশ্ন উঠলেও, আমরা কিন্তু কোষাগারের খরচ আর সরকারের দাবির মধ্যে মিল খুঁজে পাচ্ছি না, সাধারণ পাটিগণিতে। এটাই মোদ্দা কথা।
আসি রাজ্য প্রসঙ্গে। এই মুহূর্তে প্রধান সমস্যা হল নাগরিকের স্বাস্থ্য এবং পেটের ভাত। করোনা লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ খরচ কিন্তু হচ্ছে রাজ্যের গ্যাঁট থেকেই। এখানেও কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার দায় চাপিয়ে দিয়েছে রাজ্যগুলির ঘাড়েই। মনে রাখতে হবে রাজ্যের কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতো গৌরী সেন নেই। চাইলেই তারা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কাছ থেকে টাকা তুলতে পারে না। জিএসটি খাতেও প্রাপ্য অর্থ বহু দিন ধরেই ঠিক মতো তারা পাচ্ছে না। এপ্রিলের হিসাবেই দেখা যাচ্ছে— রাজ্যগুলির জিএসটি বাবদ ৩০ হাজার থেকে ৩৪ হাজার কোটি টাকা পাওনা থেকে গিয়েছে ডিসেম্বর-জানুয়ারির প্রাপ্য খাতে। তার মধ্যে কিছু টাকা কেন্দ্রীয় সরকার ছেড়েছে, কিন্তু বাকি রয়ে গিয়েছে একটা বড় অংশই।
অর্থ কমিশনের হিসাব অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১৪টি রাজ্যের রাজস্ব ঘাটতি বাবদ চলতি আর্থিক বছরে ৭৪ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা প্রাপ্য হবে কেন্দ্রের কাছ থেকে। এখনও পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী তার মধ্যে কেন্দ্র দিয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা।
অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দুটো দিক। বাজার চালু করা। শুধু উৎপাদন করলেই হবে না। বাজারে তার ক্রেতাও থাকতে হবে। নাগরিকের পকেটে টাকা না থাকলে কিনবে কে? আর অন্য দিকটা হল খিদে আর করোনার বিরুদ্ধে লড়াই। যা কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে দাড়িয়ে করতে হচ্ছে রাজ্যগুলোকেই। তাদের হাতে টাকা আসা দরকার, না হলে এই লড়াইয়ে যতই ঘন্টা বাজাই আর ফুল ছিটোই, আখেরে মরবে সাধারণ মানুষই। বাজাজ অটোর ম্যানেজিং ডিরেক্টর রাজীব বাজাজ কিন্তু সরাসরি বলে দিয়েছেন কেন্দ্রের প্যাকেজ নিয়ে তিনি হতাশ। আর অঙ্কই বলে দিচ্ছে প্রতিশ্রুতি যা পাওয়া গিয়েছে তা শুধু কাগজের আর স্লোগানের। এ লড়াই কি সত্যিই আমরা জিততে চাইছি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy