সমবায় ব্যাংকগুলির হাল ফিরাইবার ডাক দিয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর্থিক পরিষেবার ক্ষেত্রে সমবায় ব্যাংক চিরকালই দুয়োরানি। বামফ্রন্ট ‘সমবায় আন্দোলন’-এর সাড়ম্বর অঙ্গীকার করিয়া সাধারণ পরিষেবাগুলিও গ্রামের মানুষের নিকট পৌঁছাইতে পারে নাই। দুর্নীতি ও দলতন্ত্রের ভারে সমবায়গুলি গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে অগ্রণীর ভূমিকা হইতে স্খলিত হইয়া গলগ্রহে পরিণত হইয়াছিল। সমবায়ের দুর্বলতা এই রাজ্যে বেআইনি অর্থ লগ্নি কারবারের রমরমার অন্যতম কারণ। তৃণমূল সরকারের প্রথম পাঁচ বৎসরে গ্রামে ব্যাংকিং পরিষেবার কিছুটা উন্নতি হইয়াছে। গ্রামের দরিদ্রের নিকট সুলভ ঋণ পৌঁছাইবার আগ্রহ দেখা দিয়াছে। বিশেষত, কৃষিঋণ ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের নিকট ঋণের অঙ্ক বৃদ্ধি পাইয়াছে। কিন্তু সমবায় ব্যাংকগুলির অবস্থা বিশেষ ফেরে নাই। শাখার সংখ্যা বাড়ে নাই, সেগুলি ‘কোর ব্যাংকিং’-এর সহিত যুক্তও হয় নাই। এমনকী ধান কিনিবার কাজেও তাহাদের ভূমিকার বিস্তার হয় নাই। রাজ্যে পাঁচ হাজারের অধিক কৃষি সমবায় সমিতি রহিয়াছে, কিন্তু ধান কিনিয়া মজুত করিবার পরিকাঠামো রহিয়াছে মাত্র দেড় হাজারটির। প্রায় অর্ধেক সমিতিরই আমানত লইবার ক্ষমতা নাই। গ্রামীণ অর্থনীতি যে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির সহিত কার্যত যুক্ত হয় নাই, তাহার অন্যতম কারণ সমবায়ের দুর্বলতা।
অথচ সমবায় ব্যাংক গ্রামের একটি বড় ভরসা। জাতীয় ব্যাংকগুলির গ্রামীণ পরিষেবার যথেষ্ট বিস্তার হয় নাই। তুলনায় অনেক বিস্তৃত সমবায় ব্যাংক। গত বৎসর এই রাজ্যের যে ১৭ লক্ষ মানুষ কিসান ক্রে়ডিট কার্ডের মাধ্যমে ফসল-ঋণ পাইয়াছিলেন, তাহার ১১ লক্ষের অধিক সমবায় ব্যাংকের গ্রাহক। গত বৎসর তিন হাজার কোটি টাকা চাষির নিকট পৌঁছাইয়াছে সমবায় ব্যাংকের মাধ্যমে। কিন্তু এই সাফল্যের বিপরীতে ব্যর্থতাও প্রকট। প্রথমত, সরকারি হিসাবেই রাজ্যে কৃষিঋণ পাইবার যোগ্য চাষি অন্তত বাহাত্তর লক্ষ। অর্থাৎ যোগ্যদের মধ্যে চার জনে তিন জনই এখনও প্রাতিষ্ঠানিক ফসল-ঋণের আওতার বাহিরে। দ্বিতীয়, সমবায় ব্যাংক হইতে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাথাপিছু ঋণের মাত্র ত্রিশ শতাংশ। সত্য বটে, সমবায় ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিই অধিক, কিন্তু বাস্তবিক উৎপাদনের যাহা খরচ, তাহা যদি উৎপাদনকারী হাতে না পান, তাহা হইলে কৃষক ও কৃষির মহাজন-নির্ভরতা কমিবে কী রূপে?
মুখ্যমন্ত্রী যে ঘোষণা করিয়াছেন, তাহার মধ্যে সর্বাধিক আশাপ্রদ সম্ভবত এই কথাটি যে, তিনি সমবায় সঞ্জীবনের রূপরেখা স্থির করিতে একটি কমিটি গঠনের কথা বলিয়াছেন, এবং কমিটিকে ছয় মাস সময় দিয়াছেন। আশা করা যায়, ইহা কেবল চমকপ্রদ ঘোষণা নহে। দীর্ঘমেয়াদি এবং জটিল একটি কাজের জন্য একটি সুচিন্তিত কর্মপদ্ধতি তৈরি করিবার প্রয়োজনের স্বীকৃতি। রাজ্যে পাঁচ হাজারেরও অধিক সমবায় সমিতি ‘কোর ব্যাংকিং’ সংযোগ পাইলে তাহাতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি ছোটখাটো বিপ্লব আসিতে পারে। ঘরের কাছে ব্যাংকিং পরিষেবা দরিদ্রের সক্ষমতা বহুগুণ বাড়াইবে। তৎসহ যদি সমিতিগুলি বাস্তবিক সমবায়ের নীতি মানিয়া কাজ করিতে পারে, তবে সম্পদের বণ্টনের সহিত দরিদ্রের সমান মর্যাদার লক্ষ্যেও আগাইতে পারিবে পশ্চিমবঙ্গ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy