টাইগার হিলের পথে যান নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত লইয়াছে দার্জিলিং জেলা পুলিশ। দিনে তিনশত’র বেশি গাড়ি সেই পথে চলিবে না। সিদ্ধান্তের কারণ, প্রবল যানজট। তাহা ঠেকাইতে সারা শহর জুড়িয়াই যান নিয়ন্ত্রণের ভাবনা। গাড়ি রাখিবার স্থানগুলি নির্দিষ্ট হইতেছে, কিছু জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রের সামনে গাড়ি পার্কিং বন্ধের কথাও বলা হইয়াছে। তবে, এই কর্মসূচি পুলিশের নির্ধারিত কার্যের মধ্যেই পড়ে। ইহার মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ টাইগার হিলে যান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি। প্রস্তাবিত সংখ্যাটি কার্যকর হইলে বলা যায়, ভরা মরসুমে কয়েক হাজার পর্যটকের উদ্যত ক্যামেরার ফাঁক গলিয়া কোনও ক্রমে সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করিবার হয়রানি কিছুটা কমিবে। সঙ্গে হয়তো কমিবে দূষণের মাত্রাও। যে ভাবে প্রতিনিয়ত প্রায় হাজারখানেক গাড়ি এই পথে যাতায়াত করে, তাহা পাহাড়ের পরিবেশকে বিপন্ন করিবার পক্ষে যথেষ্ট। এত বৎসরের সেই ক্ষতি অ-পূরণীয়। তবে যান নিয়ন্ত্রিত হইলে অধিকতর ক্ষতির সম্ভাবনা কিছু কমিতে পারে।
কিন্তু সামগ্রিক ভাবে দার্জিলিংয়ের কী হইবে? নিঃসন্দেহে শৈলরানি ধুঁকিতেছে। বয়সের ভারে নহে, মাত্রাছাড়া দূষণ এবং বেহিসাবি নগরায়ণের ভারে। বস্তুত, মানুষের অবিমৃশ্যকারিতা এবং লোভ পৃথিবীকে কোন ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে লইয়া যাইতেছে, দার্জিলিং তাহার এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, কিন্তু অসাধারণ উদাহরণ। একদা ব্রিটিশদের সাধের পাহাড়টির এখন ক্ষতবিক্ষত দশা। পাহাড়ের ঘন সবুজ মুখ লুকাইয়াছে কংক্রিটের আড়ালে। বুনো ফুলের সৌন্দর্য ম্লান করিয়াছে নরম পানীয়ের বোতল, ক্যান এবং খাবারের চিত্রবিচিত্র প্যাকেট। পর্যটকদের চাহিদা মিটাইতে ছোট, সুন্দর জনপদ মিরিকও পরিণত হইয়াছে হোটেলের জঙ্গলে। জায়গাটির সৌন্দর্য অন্তর্হিত হইয়াছে, সঙ্গে পর্যটকদের দাক্ষিণ্যে প্লাস্টিক ও আবর্জনার স্তূপ জমিয়াছে লেক-এর শরীরে। আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাইতেছে মহানন্দা নদীর দূষণ। ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালের পক্ষ হইতে সেই মর্মে রাজ্য সরকারের প্রতিক্রিয়া চাওয়া হইয়াছে। পর্যটন-নির্ভর পাহাড়ের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির তাগিদে নির্বিচারে কোতল হইয়াছে পাহাড়ি সৌন্দর্য, আলগা হইয়াছে মাটি। দার্জিলিং এখন বিরাট সর্বনাশের মুখে।
এই অবক্ষয় দীর্ঘ দিনের ফল। কিন্তু এত দিনেও টনক নড়ে নাই কেন? সিকিম কবেই প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করিয়াছে, সফল ভাবে যান নিয়ন্ত্রণ করিয়াছে। দার্জিলিং পারিল না। কেন? সদিচ্ছার অভাবে। ব্রিটিশরা যে শহরকে সাধ করিয়া সাজাইয়াছিল, গত কয়েক দশকে তাহা তিলে তিলে নষ্ট হইয়াছে চূড়ান্ত অবহেলায়। রাজ্য সরকার পাহাড়ের রাজনীতি লইয়া যতটা উদ্বিগ্ন, পাহাড়ের পরিবেশ রক্ষায় তাহার কানাকড়িও নহে। সরকারের নাকের ডগায় পরিবেশকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া চলিয়াছে বেআইনি নির্মাণকাজ। অন্য দিকে, ভূমিপুত্ররা স্বশাসনের দাবিতে পথে নামিয়াছেন, কিন্তু সেই অধিকার কিছুটা পাইয়াও পরিবেশের যত্ন লন নাই। তাঁহারাও পাহাড়কে নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধ্বংসের দিকে ঠেলিয়া দিয়াছেন। রহিলেন পড়িয়া পর্যটকরা। তাঁহারা তো দিনকয়েকের অতিথি, পাহাড়কে ভোগ করেন, চলিয়া যান। পাহাড় বাঁচিল না মরিল, তাহাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখান না। দুর্ভাগ্য। এক কালে দার্জিলিংকে ডাকা হইত ভারতের ‘মুকুটের মণি’ বলিয়া। সেই পরম সম্পদটির গৌরব পশ্চিমবঙ্গই ধরিয়া রাখিতে পারিল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy