দাবি: রাজ্যসভার চেয়ারপার্সনের কাছে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব জমা দেওয়ার পরে বিরোধী নেতারা। ছবি: পিটিআই
সে দিন ছিল ইজরায়েলের জাতীয় দিবস। দিল্লির এক পাঁচতারা হোটেলে বর্ণাঢ্য নৈশভোজ। সেখানে দেখা বিজেপির এক বিতর্কিত রাজ্যসভা সাংসদের সঙ্গে। প্রবীণ মানুষটি ইজরায়েলের দীর্ঘদিনের বন্ধু। সাদা টেবিল ক্লথ, ছোট-ছোট, গোল-গোল বা লম্বা-লম্বা টেবিল। পানীয় আর টুকটাক খাবার আসছে। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গপ্পো করছিলাম। শুধু বিজেপি নয়, সব দলেরই বহু নেতা উপস্থিত। আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। ২০১৯-এর ভোট কী হতে পারে আর কী হতে পারে না, এ তো এখন রাজধানীর যে কোনও সান্ধ্য আড্ডার সুপারহিট আলোচ্য বিষয়। তা ওই ঠোঁটকাটা নিরামিষাশী সাংসদ কথায় কথায় বললেন, দেখুন ওই পরিচারকটি ট্রেতে করে কিছু খাদ্যবস্তু নিয়ে আসছে। ওটি নিরামিষ না আমিষ, তা প্রেডিক্ট করতে পারব না। কিন্তু এটা আজই বলে দিতে পারি, লোয়া মামলায় আগামী কাল সুপ্রিম কোর্ট অমিত শাহকে বেকসুর খালাস করে দেবে। এ মামলা ধোপেই টিকবে না।
পরের দিন শীর্ষ আদালত বিচারক ব্রিজগোপাল হরকিষণ লোয়া-র ‘রহস্যজনক’ মৃত্যুতে নতুন করে নিরপেক্ষ তদন্তের আর্জি খারিজ করে দিল। ২০ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র এই রায় দিয়েছেন। তার ঠিক এক দিন আগে ওই বিজেপি সাংসদের ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে তিনি বলতেই পারেন, সেটি ছিল তাঁর তীব্র বিশ্বাসজাত। যেমন ওই দিনই বেশ কয়েক জনের সামনেই তিনি আরও ভবিষ্যদ্বাণী করেন, এ বার প্রধান বিচারপতি রামমন্দির নির্মাণের পক্ষেও এক ঐতিহাসিক রায় দিতে চলেছেন। লোয়া নিয়ে এই রায়ের পর রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে বিরোধীদের একাংশ প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব আনার উদ্যোগ করেছেন। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব আনা উচিত কী উচিত নয়, সে ভিন্ন প্রশ্ন। রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের এই প্রস্তাব খারিজ করে দেওয়া ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু বিচারক লোয়ার মৃত্যু সম্পর্কে প্রধান বিচারপতির রায় ও তার ভাষা দেখে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার স্বাধীন ভাবে কাজ করার সামর্থ্য নিয়ে সংশয় হয়। সুপ্রিম কোর্টে যদি যান, ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণে বয়স্ক অশ্বত্থ গাছটির তলায় দাঁড়ালে কালো কোট আর সাদা পোশাক পরিহিতদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাবেন। তাঁরা আলোচনা করছেন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে তোলা পুরনো নানা অভিযোগ নিয়ে। বার লাইব্রেরিতে গেলাম, কত বছর পর! অশোক সেন যখন ছিলেন, তখন এখানে আসতাম।
ওঁর কাছ থেকে কত গপ্পো শুনতাম। এত বছর পর সেখানে এক আইনজীবী বন্ধুবরের সঙ্গে গিয়ে শুনলাম, সবাই বলছেন, বিচারব্যবস্থার এই হাল আগে দেখা যায়নি। চার দিকে ভাসছে নানা গুজব। নানা কাহিনি। সেগুলি বিচারব্যবস্থার পক্ষে সম্মানের নয়।
ভারতের এক জন মানুষ শুধু নই, আমি এ রাষ্ট্রের নাগরিকও। প্রধান বিচারপতির রায় আমার পছন্দ না হতে পারে, উচিত বলে মনে না হতে পারে। কিন্তু, প্রধান বিচারপতির রায় পক্ষপাতদুষ্ট— সাংবিধানিক ভাবে আমি এ কথা কখনওই বলব না। রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের ‘পারসেপশন’ বা ধারণার একটা বিশেষ মূল্য আছে। প্রধান বিচারপতি যতই কঠোর ভাষায় বলুন না কেন যে রাজনৈতিক বিরোধিতাকে আদালতে টেনে এনে বিচারবিভাগকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, তাতেও কিন্তু এ দেশের বহু মানুষের ‘পারসেপশন’-এ বদল আসেনি। এ দেশের নাগরিক সমাজের এক বড় অংশ মনে করছেন যে আসলে এই রায়ের মধ্য দিয়েই বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতার কফিনে শেষ পেরেকটি প্রোথিত হল। চার বিচারপতির পত্রবোমা যে ভাবে প্রধান বিচারপতির কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়, তা নিয়ে কিছু দিন আগে বিতর্ক হয়। এ ভাবে প্রকাশ্যে চার বিচারপতি আদালতের বাইরে বাড়ির সবুজ লনে সাংবাদিকদের ডেকে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারেন কি না তা নিয়েও মতভেদ হতে পারে, কিন্তু কোন মামলা কোন আদালতে যাবে তা একা প্রধান বিচারপতি ঠিক করলে সরকার পক্ষের বহু মামলা যে আড়াল হতে পারে, সে অভিযোগ আরও সজীব হয়, লোয়া মামলা এ ভাবে খারিজ হয়ে যাওয়ায়। সে দিন ওই বিদ্রোহী বিচারপতিরাও তো লোয়া মামলার ভবিষ্যৎ নিয়েও আগাম সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।
রাজ্যে রাজ্যে বিচারপতি নিয়োগ নিয়েও সরকারের সঙ্গে হাইকোর্টগুলির নানা স্তরে নানা ক্ষেত্রে বিরোধ চলছে। কলেজিয়াম বা শীর্ষ আদালতের নির্বাচকমণ্ডলী যাঁদের নাম স্থির করছে, চলতি আইনে সেই প্যানেল মানতে সরকার বাধ্য। বড় জোর আলাপ-আলোচনার অছিলায় সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি করতে পারে। কলকাতা হাইকোর্টে কত দিন হয়ে গেল আইনজীবীদের হরতাল চলছে, এরই ডামাডোলে চার বিচারপতি নিয়োগও আটকে রেখেছে কেন্দ্র। কেন্দ্রের মনোভাব হল, হরতাল করছেন, করুন। আমরাও সমাধান চাই না। দেখি, কত দিন এই ধর্না চালাতে পারেন? এটা কি শিশুদের কোনও প্রতিযোগিতা! বিচারব্যবস্থাকে নিয়ে এ ভাবে ছিনিমিনি খেলা ভাবা যায় না। এতে সার্বিক ভাবে দিল্লীশ্বর এবং আজকের শীর্ষ আদালত সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কী ‘ধারণা’ হচ্ছে তা কি তাঁরা বুঝতে পারছেন না? না কি বুঝেও বুঝতে চাইছেন না? ভাবের ঘরে চুরি করছেন?
পার্লামেন্ট লাইব্রেরিতে ভারতের সংবিধানের প্রথম প্রস্তাবনাটি কাচের বাক্সে রাখা। আজ যখনই সেখানে যাই, মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। অম্বেডকর, নেহরু ও আরও অনেকেই এই সংবিধানটি রচনার জন্য কী কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। কত বিতর্ক হয়েছে গণ পরিষদের বৈঠকে। চেষ্টা হয়েছে, যাতে আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হয়। মার্কিন সংবিধানে একেই বলা হয়েছিল চেক অ্যান্ড ব্যালান্স। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের কথা মনে করা যেতে পারে। অন্তর্নিহিত ক্ষমতার তত্ত্বের মোড়কে জাস্টিস মার্শাল আইন পুনর্বিবেচনার কথা বলেন। ১৮০৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্টের প্রশাসনিক ক্ষমতা অতিক্রম করা হয়। এখানেই নিহিত ছিল বিচারবিভাগীয় অতিসক্রিয়তার ভূত। রুজভেল্টের নয়া আর্থিক ডিল নিয়েও শাসন ও বিচার বিভাগের সংঘাত হয়। ভারতেও দেখেছি, যখনই শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাব হচ্ছে, তখনই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিচারবিভাগের দাদাগিরি শুরু হয়। এ দেশে অবশ্য এখন প্রবলপরাক্রান্ত সংখ্যার গণতন্ত্র। আর তাই বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তার বদলে অভিযোগ উঠেছে ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডের নিয়ন্ত্রণের। এখন এই প্রভুভক্তদের দেশে বিচারের বাণী কাঁদারও কোনও সুযোগ পাচ্ছে না।
তবু সব শব্দ থেমে যাওয়ার পরও থেকে যায় আমাদের নিজস্ব ধারণার স্ব-শাসন। সেখানে প্রমাণ, আইন, সূক্ষ্ম তর্ক, সব বৃথা। আডবাণীর বিরুদ্ধে যখন হাওয়ালা চার্জশিট হয়, তখন তিনি ইস্তফা দেন। কিন্তু কিছুতেই মানুষ বিশ্বাস করেননি যে তিনি এ কাজ করেছেন। পরে প্রমাণ হয় যে তিনি নির্দোষ। এটাই পারসেপশনের রাজনীতি। মমতা সম্পর্কে যে যা-ই অভিযোগ করুন, আজও মানুষ বিশ্বাস করতে প্রস্তুত নন যে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে অসৎ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কেও যে যা-ই বলুন, আজ এত বছর পরও আমি তা বিশ্বাস করতে পারি না।
অথচ মানুষ বিশ্বাস করে ইন্দিরা গাঁধী বিচারব্যবস্থার উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলেন। আবার আজ আমজনতার পারসেপশন, ভারতীয় বিচারব্যবস্থা কর্কট রোগে আক্রান্ত। আর তাই শাসক প্রভুদের নিয়ন্ত্রণও ভয়াবহ। সর্ষের মধ্যে ভূতের শাস্তি তবে হবে কী করে? বিচারপতি, তোমার বিচার করবে যারা সেই জনতার ঘুম বোধ হয় ভাঙছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy