কারারুদ্ধ বাবার সঙ্গে মেয়ে দেখা করতে গেল। শিখে এল প্রতিশোধের মন্ত্র। বাবা নিজের পরিবারের লোকজনকে খুনজখমের চেষ্টা করেছিলেন। সন্তানের হাতেও সেই দায়িত্ব তুলে দিলেন। হিংসার উত্তরাধিকার সরাসরি বার্তা দিল বাংলা সিরিয়ালের দর্শকদের। আমরা ‘মাওবাদ’ শুনলে কেঁপে উঠি। ‘আইএসআই’-এর নামে ভ্রু কুঞ্চিত হয়। রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনার শেষ নেই। অথচ দিনের পর দিন বাংলা সোপ প্রত্যেক পরিবারের বসার এবং শোয়ার ঘরে অপহরণ, খুন ইত্যাদির কাহিনি শুনিয়ে চলেছে। তাতে নাকি হিংসার প্রচার হচ্ছে না!
ধর্মীয় মৌলবাদ, কুসংস্কার এবং হিংসা এখন অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। বাংলা সিরিয়াল এ ক্ষেত্রেও পারঙ্গম। সিঁদুরের কৌটো পড়ে গেলে, পূজার ভোগে আমিষ মিশলে যে আবহসঙ্গীত বাজে, ভয় হয় বুঝি বোমা পড়ল। নবপরিণীতা বধূ তো সীতা, সাবিত্রী, অপালা, প্রজ্ঞাপারমিতা-র জ্বলন্ত কম্বিনেশন! ফুটবল খেলেন, পুলিশও হন। অথচ তাঁকে যখন খুশি অপমান করা যায়, বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া যায়। এই নিরন্তর অপমান, নির্যাতন সমাজের উপর কী প্রভাব ফেলে, তার খবর কে নিচ্ছে?
প্রতিবেশীর বাড়িতে এক বিবাহ অনুষ্ঠানে ‘সঙ্গীত’-এর নিমন্ত্রণ পেলাম। কবে বাংলার বিবাহ-আয়োজনে এই সব ঢুকে পড়ল? যদি পরিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে ঢোকে, কিছুই বলার নেই। কিন্তু যদি জোর করে সিনেমা, সিরিয়ালের মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতিকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ভুল ভাবে উপস্থাপন করা হয়, তবে শুধু সংস্কৃতি নয়, বাংলার ইতিহাসও মর্যাদা হারায়। সব কিছুর প্রেক্ষাপটেই তো রাজনীতি থাকে। কী জানি, এ ক্ষেত্রেও ‘বিদ্যাসাগর’-এর লেখা কোনও সহজ পাঠ আছে কি না!
প্রাক্তন রাজ্যপাল থেকে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী, বাংলা সিরিয়ালকে সকলেই সংযত হতে বলেছেন। এতেই বোঝা যায় সমাজে এর কতখানি অভিঘাত। এ বার কিন্তু একটা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন। সেই নিয়ন্ত্রণ ‘শিল্পের স্বাধিকারের বিষয়’ হবে কি না, বলা মুশকিল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন।
সোশ্যাল মিডিয়া থেকে চায়ের দোকান— সিরিয়াল নিয়ে হাসাহাসি সর্বত্র। স্ক্রাবার দিয়ে রোগীর জ্ঞান ফেরানো, কখনও ককপিটে না যাওয়া গৃহবধূর আকস্মিক ভাবে বৈমানিক হয়ে ওঠা, পড়তে না বসে পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর— উপহাসের কারণ। বাণিজ্যের পাশে নির্মল হাসির জোগান এই ভাবে অব্যাহত থাকলে, মন্দ কী! শিল্পের তালুকে মত্ত হস্তী ঢুকে পড়ে মাত্র। কিন্তু মধ্যবিত্ত বা সমাজের অন্য স্তরের বাঙালির জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তারকারী সিরিয়াল যদি নিরন্তর হিংসা এবং কুসংস্কারের প্রচার করে, তবে তা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ‘সঙ্গীত’-এর সঙ্গে বধূ নির্যাতন, হত্যাও সিরিয়ালের উপজীব্য হয়ে উঠলে সামাজিক সঙ্কট তৈরি হতে বাধ্য।
উদ্ভট কাণ্ডকারখানা দেশবিদেশের অনেক সিরিয়াল, সিনেমাতেই দেখা যায়। মানুষ সেই রকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই সে সব দেখতে বসেন। ব্যক্তিগত জীবনকে তার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে না। বাংলা সিরিয়াল কিন্তু পরিচিত পরিমণ্ডলকেই তুলে ধরে। আত্মীয় বান্ধবের চেনা গণ্ডিতে যখন দর্শক ঘোরাফেরা করছেন, তখনই হঠাৎ শুরু হয় পরিবারের সদস্যদের খাবারে বিষ দেওয়া, অপহরণ করে খুন। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একাধিক বিবাহ চলে। ৪৯৮-এর আশ্বাসকে উড়িয়ে পরিবারের সকলে মহিলা সদস্যকে যথেচ্ছ নির্যাতন করেন। পূজার ঘট ঘুরলে ‘সাংবিধানিক সঙ্কট’ উপস্থিত হয়। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ গৃহবধূর বাধ্যতামূলক গুণ বলে ধরা হয়। এর প্রভাব সরাসরি পড়ে বাঙালির অন্দরমহলে।
ঝগড়াঝাঁটি থেকে লাঠালাঠি, সবই আমাদের পারিবারিক জীবনে ঘটে। কিন্তু দীর্ঘ ষড়যন্ত্র, ছদ্মবেশ, বিদেশি গোয়েন্দা গল্পের অনুকরণে হত্যা এবং সেই রহস্যের সমাধান ইত্যাদি যে পরিবারের সদস্যেরা করতে পারেন, আগে কল্পনাতেও আসত না। এখন আসে। খবরের কাগজে প্রায়শই দেখা যায় পরকীয়ার খাতিরে স্বামী বা স্ত্রী পরস্পরকে চক্রান্ত করে হত্যা করছে বা হত্যার সুপারি দিচ্ছে। বলি দেওয়া, শরীর এবং মনের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর ‘ধর্মীয়’ আচারবিচার পালনের কুদৃষ্টান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। বাঙালিকে তার নাড়ির সঙ্গে সংযোগবিহীন এমন সব ঘটনা ঘটাতে যারা উৎসাহ দিচ্ছে, তাদের মধ্যে বাংলা সিরিয়াল থাকতেই পারে। নিজেদের অজানতেই তারা হিংসা এবং কুসংস্কারের প্রতীক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
অতীতে বাংলায় সামান্য বাজেটে অসাধারণ সিরিয়াল হয়েছে। তখন এত বাণিজ্যিক চ্যানেল ছিল না। মানুষ সেগুলি দেখেছেন। আজ হয়তো সাদামাটা মরমি কাহিনি তাঁদের ভাল লাগবে না। বাংলা সাহিত্যের রাজকীয় ঐশ্বর্যের ঝলকও টিভিতে দেখতে চাইবেন না। এমন আশঙ্কা পরিচালক, প্রযোজকদের থাকতেই পারে। সঙ্গে একটি প্রশ্নও থাকছে। দর্শকের রুচির জন্য সিরিয়াল বদলেছে, না কি সিরিয়ালই দর্শকের রুচিকে বদলেছে? উত্তর যা-ই হোক, বাংলা সিরিয়ালে এই নিরন্তর হিংস্রতা এবং অবিজ্ঞানের প্রবাহ বন্ধ হওয়া এখনই দরকার।
প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy