Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪
কংগ্রেস ঠিক কী করতে চায়

মোদীকে হারাতে অতিজাতীয়তাবাদী হওয়ার প্রয়োজন নেই

কংগ্রেসের লড়াই শুধুমাত্র মোদীর বিরুদ্ধে ছিল, সে কথা বললে অবশ্য মোক্ষম ভুল হবে। আজ নয়, দীর্ঘ দিন ধরেই কংগ্রেসকে ডুবিয়ে চলেছে আঞ্চলিক নেতাদের স্বার্থের সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় স্বার্থের অসামঞ্জস্য।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৯ ০০:৪৮
Share: Save:

রাহুল গাঁধী শেষ অবধি কংগ্রেসের সভাপতি থাকবেন কি না, এখনও জানা গেল না। কিন্তু, এটুকু সম্ভবত বলেই ফেলা যায়, সভাপতি পাল্টালেও খুব সুবিধা হবে না কংগ্রেসের। কারণ, সমস্যা অন্য জায়গায়। হ্যাঁ, রাহুল তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো বক্তা নন। একটা গোটা জনসভা বা একটা গোটা দেশের মানুষকে মুগ্ধ করে রাখার মতো নাটকীয় বাক্ভঙ্গি তাঁর নেই। তবুও, নরেন্দ্র মোদীর কাছে হেরে গিয়েছেন রাহুল গাঁধী, এটা বলার মধ্যে একটা অতিসরলীকরণ আছে। তার চেয়েও বড় কথা, মোদীকে হারাতে গেলে মোদীতর হতেই হবে, তেমন বাধ্যবাধকতাও নেই মোটে। বরং, অতিজাতীয়তাবাদের উত্তরে অতিজাতীয়তাবাদ, উগ্র হিন্দুত্বের জবাবে নরম হিন্দুত্ব— এই ছকে খেলার অর্থ, মোদীর মাঠে নেমে তাঁকে হারানোর চেষ্টা করা। কাজটা অসম্ভব কঠিন। তার চেয়ে কংগ্রেস মাঠটাকে বদলে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারত।

কংগ্রেসের লড়াই শুধুমাত্র মোদীর বিরুদ্ধে ছিল, সে কথা বললে অবশ্য মোক্ষম ভুল হবে। আজ নয়, দীর্ঘ দিন ধরেই কংগ্রেসকে ডুবিয়ে চলেছে আঞ্চলিক নেতাদের স্বার্থের সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় স্বার্থের অসামঞ্জস্য। তার ফল হয়েছে মারাত্মক— কংগ্রেস হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকগুলো ব্যক্তিস্বার্থের গুচ্ছ। তেলঙ্গানায় দলের ভাঙনের মধ্যেও সেই ব্যাধির ছাপ স্পষ্ট। সেখান থেকে দলকে একটা রাজনৈতিক আন্দোলনের মুখ হিসেবে ফিরিয়ে আনবেন কী করে, রাহুলদের এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। এই নির্বাচনে সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টাটুকুও করেননি তাঁরা। ভরাডুবির সেটা বড় কারণ তো বটেই। এই কাজটা করার জন্য শুধু মোদী-বিরোধিতাই যথেষ্ট ছিল না। তাঁর অতিজাতীয়তাবাদী রাজনীতির পরিবর্তে কংগ্রেস কী দিতে চায়, এবং কেন, এই কথাটা দেশ জুড়ে এক সুরে বলার প্রয়োজন ছিল।

কংগ্রেসকে লড়তে হলে অতিজাতীয়তাবাদের বিকল্প খুঁজে নিতে হবে কেন? মানুষের রাজনৈতিক কল্পনার পরিসরে আপাতত অতিজাতীয়তাবাদ আর বিজেপি, বা আরও স্পষ্ট করে বললে, নরেন্দ্র মোদী, একাকার। সেই পরিসরে ঢুকতে গেলে কার্যত দ্বিতীয় বিজেপি হতে হয়। কিন্তু, তার চেয়েও বড় কারণ, এই নির্বাচনের ফল যা-ই হোক না কেন, ভারতে অতিজাতীয়তাবাদ দীর্ঘায়ু হবেই, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। কেন, সে কথা বলার চেষ্টা করব।

কংগ্রেস নেতারা ২০০৪ সালের কথা ভেবে দেখলে পারেন। ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর প্রবল প্রচারের মুখে কংগ্রেস ‘ভারত নির্মাণ’-এর কথা বলেছিল। বাজারমুখী উন্নয়নের উল্টো দিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল অধিকারভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্রকে। বলেছিল, বাজার থেকে যাঁরা বাদ পড়ে গেলেন, অথবা যাঁরা বাজারের প্রবেশাধিকারই পেলেন না, ক্ষমতায় এলে সেই ভারতীয়দের উন্নয়নের চেষ্টা করবে কংগ্রেস। ঠিক দশ বছর পরে, নরেন্দ্র মোদী উল্টে দিয়েছিলেন আখ্যানটিকে। বলেছিলেন, রাষ্ট্রনির্ভর দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থা নয়, উন্নয়ন আসবে গুজরাত মডেলে চেপে, বাজারের মুকুট মাথায়। পুরনো কাসুন্দি টানছি একটাই কারণে— সর্বভারতীয় দল হিসেবে নির্বাচন লড়তে হলে একটা সর্বভারতীয় আখ্যান প্রয়োজন। তাতে শুধু চলতি ব্যবস্থার সমালোচনা থাকলেই হয় না, পাশাপাশি একটা বিকল্পের হদিশও দিতে হয়।

নরেন্দ্র মোদীর রাজনীতির একটা প্রতিস্পর্ধী বিকল্প তৈরি করা, এবং দেশের সব প্রান্তে দলকে সেই ভাষ্যের সুরে বাঁধা, এই দুটো কাজ করার জন্য কংগ্রেসের অতিজাতীয়তাবাদী হুঙ্কার দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। এই দফায় যে অর্থনীতিই নরেন্দ্র মোদীর অ্যাকিলিসের গোড়ালি, কংগ্রেস এই কথাটা বুঝেও বুঝল না। শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে গেল নরেন্দ্র মোদীর তৈরি করে দেওয়া আজেন্ডাতেই। চৌকিদার চোর হ্যায় কি না, তার চেয়ে অনেক জরুরি ছিল এই প্রশ্ন করা যে পাঁচ বছর আগে অর্থনীতি নিয়ে যে সব প্রতিশ্রুতি মোদী দিয়েছিলেন, সেগুলো পূরণ করা গেল না কেন? নরেন্দ্র মোদী সুকৌশলে অর্থনীতির প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন এ নির্বাচনে— আর কংগ্রেসও ধাওয়া করে গেল তাঁকে। ফল যা হওয়ার, হল।

অর্থনীতিই যদি দুর্বলতা হয়, সেই প্রসঙ্গ তো নেহাত কম তোলেননি বিরোধীরা— তা হলে, বিজেপি গত বারের চেয়ে ছয় শতাংশ-বিন্দু ভোট বাড়িয়ে নিল কী ভাবে? মনে রাখা ভাল, দীর্ঘ দিন পরে এই প্রথম কোনও লোকসভা নির্বাচনের বছরে মূল্যস্ফীতির হার এত কম। ২০১৪ সালে যখন মনমোহন সিংহের সরকারের দ্বিতীয় দফা শেষ হয়েছিল, ভোগ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার ছিল দশ শতাংশেরও বেশি। এই বার তা ছিল সাড়ে চার শতাংশের কাছাকাছি। মূল্যস্ফীতির হার কমায় নরেন্দ্র মোদীর কৃতিত্ব খুব বেশি নয়। কিন্তু, সাধারণ মানুষ অর্থনীতির স্বাস্থ্য মাপে মূল্যস্ফীতির থার্মোমিটারে। এই দফায় বিজেপি সেই সুবিধা পেয়েছে।

এর চেয়েও একটা বড় কথা রয়েছে— অর্থনীতির প্রশ্ন তখনই মানুষকে ভাবায়, যখন তাকে জুড়ে দেওয়া যায় মানুষের দৈনন্দিনতার সঙ্গে। জিডিপি’র বৃদ্ধির হার বা ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণ নিয়ে খবরের কাগজের পাতায় বা টেলিভিশনের তর্কে কথা বলা যায় যত খুশি, কিন্তু সেই কথা সম্ভবত একটা ছোট বৃত্তের বাইরে বেরোয় না। সেই বড় জনসমষ্টির কাছে পৌঁছোতে হলে অর্থনীতির যুক্তিগুলোকে অনুবাদ করে নিতে হত সাধারণ মানুষের ভাষায়। কংগ্রেস বলেছে, কর্মসংস্থানহীনতার হার ৪৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু, আমার-আপনার ঘরের ছেলেটা বা মেয়েটা পাশ করেও চাকরি পাচ্ছে না, সেটা যে শুধু তার নিজের দোষে নয়, বরং অনেক বেশি করে নরেন্দ্র মোদীর ভ্রান্ত নীতির দোষে, সেই কথাটা আর ভেঙে বলেনি। ব্যাঙ্কে অনাদায়ী ঋণ বাড়তে থাকলে, দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ কমলে অথবা সরকার নোট বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত করলে তার আঁচ সাধারণ মানুষের জীবনে কী ভাবে পড়ছে, সেই ক্ষতচিহ্নগুলোকে দেখিয়ে দেওয়া প্রয়োজন ছিল। গত পাঁচ বছরে মোদীর অর্থনৈতিক ব্যর্থতা যতখানি, সেগুলোকে সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় প্রচার করার ক্ষেত্রে কংগ্রেসের ব্যর্থতা তারও বেশি।

পাশাপাশি, বিজেপির ভুলগুলো সংশোধন করে কোন পথে হাঁটার কথা কংগ্রেস ভাবছে, সেটা বলতে হত। কংগ্রেস যে ‘ন্যায়’ প্রকল্পের কথা বলেছিল, সেটাই হতে পারত সেই বিকল্প পথ। তবে, মানুষের দিকে ‘সামাজিক ন্যায়’ আর ‘বণ্টনের ন্যায্যতা’র মতো ভারী শব্দ ছুড়ে দিয়ে নয়। শব্দগুলো ভাঙলে সাধারণ মানুষের জন্য কোন প্রাপ্তির সন্ধান পাওয়া যাবে, আর সেগুলো কী ভাবে মানুষের প্রাত্যহিক সমস্যার সমাধান করতে পারে, বলতে হত সে কথা। যেমন, মাসে ছ’হাজার টাকা পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকলে নামমাত্র মজুরিতে কেন্দুপাতা কুড়োনোর কাজ করার বাধ্যবাধকতা থাকবে না, বরং সেই সময়টা খরচ করা যাবে তুলনায় গ্রহণযোগ্য কোনও কাজে; অথবা, সামান্য প্রয়োজনেও ধার করতে বেরোনোর দীনতা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে; এত দিন যে জীবনযাত্রা তাঁদের নাগালের বাইরে ছিল, ‘ন্যায়’ তাঁদের সেই স্তরে পৌঁছে দিতে পারবে। বিকল্প নীতি মানে যে কিছু বিমূর্ত শব্দ নয়, বরং খাওয়াপরার, সম্মানের, ভাল থাকার সন্ধান, এই কথাটা বলতে হত। সম্মানের কথাটা জরুরি। এই কথাটা নরেন্দ্র মোদী ধরতে পেরেছিলেন— উজ্জ্বলা থেকে শৌচাগার নির্মাণ, সব প্রশ্নকেই তিনি বেঁধে দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের সম্মানবৃদ্ধির তারে। অথচ, যে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম প্রকল্পের গোড়ার কথা নাগরিক হিসেবে মানুষের সম্মান, কংগ্রেস সেই কথাটা বলেই উঠতে পারল না।

এখন আর এ সব কথা বলে কী লাভ? এই প্রশ্নের বারো কোটি তেরো লক্ষ উত্তর আছে। গোটা দেশে এত জন মানুষ এ বার কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছিলেন। নেহাত কম নয়। সেই সংখ্যা আরও বাড়বে, কংগ্রেস তেমন আশা করতেই পারে। এই দফায় অন্তত দশ কোটি এমন ভোটার ছিলেন, যাঁরা ২০১৪ সালের পর ভোটাধিকার অর্জন করেছেন। সব অনুমান বলছে, এই ভোটের সিংহভাগ বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছে। এঁদের বয়স আঠারো থেকে তেইশ বছরের মধ্যে। হয় সদ্য চাকরির বাজারে ঢুকেছেন, অথবা ঢুকবেন আর দু’এক বছরের মধ্যে। নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে সেই বাজারের যে হতশ্রী চেহারা হয়েছে, গত পঞ্চাশ বছরে তত খারাপ অবস্থা কখনও হয়নি। হাল শুধরোবে, সেই সম্ভাবনাও খুব উজ্জ্বল নয়। আজ যাঁরা শক্তিশালী নেতা হিসেবে নরেন্দ্র মোদীকে বেছেছেন, চাকরির বাজারে পাঁচ বছর হেনস্থা হতে হলেও মোদীর প্রতি সমর্থন তাঁদের এতখানিই থাকবে, ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে থাকলেও এই ভোটারদের ধরে রাখার মতো জোর অতিজাতীয়তাবাদের আছে কি না, সেই পরীক্ষা এখনও হয়নি।

অন্য বিষয়গুলি:

Rahul Gandhi Narendra Modi Congress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy